রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে অগ্নিকাণ্ড: দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিস
বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রূপপুরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে স্থানীয়দের মধ্যে। তবে ফায়ার সার্ভিসের দ্রুত তৎপরতায় আগুন বড় ধরনের ক্ষতি হওয়ার আগেই নিয়ন্ত্রণে আসে। বৃহস্পতিবার (৬ নভেম্বর) বেলা ১২টা ৩২ মিনিটের দিকে এই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয় বলে নিশ্চিত করেছে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ।
অগ্নিকাণ্ডের স্থান ও কারণ
প্রাথমিক তথ্যানুসারে, বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি অংশে থাকা পরিত্যক্ত কাঠের স্তূপে হঠাৎ করেই আগুন লেগে যায়। এটি মূল উৎপাদন এলাকা থেকে বেশ দূরে অবস্থিত ছিল, ফলে পারমাণবিক স্থাপনা কোনো ঝুঁকির মধ্যে পড়েনি।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা মো. নাসির উদ্দিন জানান, “এটি সম্পূর্ণভাবে পরিত্যক্ত সামগ্রীর স্তূপ ছিল। সেখানে কাঠ, প্লাস্টিক ও কিছু পুরনো নির্মাণ সামগ্রী ছিল। কোনোভাবেই এটি মূল রিয়্যাক্টর জোন বা সংবেদনশীল এলাকায় ছিল না।”
ফায়ার সার্ভিসের দ্রুত পদক্ষেপ
ঘটনার পরপরই রূপপুর মডার্ন, গ্রীন সিটি, রূপপুর অস্থায়ী এবং ঈশ্বরদী ফায়ার স্টেশনের মোট ৮টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়।
রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের ভেতরেই একটি অস্থায়ী ফায়ার স্টেশন রয়েছে, যা দ্রুততম সময়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়। এক মিনিটের মধ্যেই ফায়ার ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে।
প্রায় ৪৫ মিনিটের টানা প্রচেষ্টার পর বেলা ১টা ১৫ মিনিটের দিকে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, “তৎপরতার কারণে বড় কোনো ক্ষতি হয়নি। যদি সামান্য দেরি হতো, তাহলে আশেপাশের কিছু নির্মাণ সামগ্রী ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারত।”
কোনো প্রাণহানি ঘটেনি
সবচেয়ে আশার কথা, এই অগ্নিকাণ্ডে কোনো প্রাণহানি বা আহতের খবর পাওয়া যায়নি। বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজে নিয়োজিত কর্মীরা দ্রুত সরে গিয়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেন।
স্থানীয় প্রশাসন ও রূপপুর প্রকল্পের নিরাপত্তা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “ঘটনার সময় শ্রমিকরা দ্রুত সরে যাওয়ায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। ফায়ার সার্ভিসের তৎপরতা প্রশংসনীয়।”
কেন্দ্রের কার্যক্রমে কোনো প্রভাব পড়েনি
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ মেগা প্রকল্পগুলোর একটি। এ কেন্দ্রের মূল লক্ষ্য দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে নতুন অধ্যায় সূচনা করা।
বৃহস্পতিবারের এই অগ্নিকাণ্ডে প্রকল্পের মূল কার্যক্রম বা বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কোনো প্রভাব পড়েনি বলে নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন।
একজন প্রকৌশলী বলেন, “ঘটনাটি পুরোপুরি বাইরের এলাকায় ঘটেছে। রিয়্যাক্টর, টারবাইন বিল্ডিং, বা কোনো সংবেদনশীল স্থাপনায় কোনো ক্ষতি হয়নি। নিরাপত্তা ব্যবস্থা একটুও বিঘ্নিত হয়নি।”
সতর্ক অবস্থায় প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনী
অগ্নিকাণ্ডের খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ ও র্যাব সদস্যরাও ঘটনাস্থলে পৌঁছান। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কোনো ত্রুটি দেখা যায়নি বলে নিশ্চিত করেছেন কর্মকর্তারা।
স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, “ঘটনার পর কেন্দ্রের আশপাশের এলাকা ঘিরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।”
অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগ জানিয়েছে, অগ্নিকাণ্ডের সঠিক কারণ অনুসন্ধানে একটি তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, পরিত্যক্ত কাঠের স্তূপে সিগারেটের আগুন বা কোনো দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে।
তদন্ত কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এক কর্মকর্তা জানান, “প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডই আমাদের জন্য একটি শিক্ষা। এই ঘটনার পর কেন্দ্রের ভেতরে নিরাপত্তা ও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।”
রূপপুর প্রকল্পের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক মান
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রকল্প, যা রাশিয়ার সহায়তায় নির্মিত হচ্ছে। এখানে নিরাপত্তা ও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রুশ প্রযুক্তি অনুযায়ী সাজানো হয়েছে।
প্রকল্পটিতে রয়েছে আধুনিক ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেম, অটোমেটিক স্প্রিংকলার, জরুরি সিঁড়ি, হাইড্রান্ট সিস্টেম এবং প্রশিক্ষিত ফায়ার টিম।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, “রূপপুর প্রকল্পে নিরাপত্তার বিষয়টি সবচেয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এখানে নিয়মিত নিরাপত্তা মহড়া হয় এবং প্রতিটি ইউনিটে ফায়ার রেসপন্স টিম প্রস্তুত থাকে।”
স্থানীয়দের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে
অগ্নিকাণ্ডের খবর শুনে প্রথমে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দেয়। অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন, পারমাণবিক কেন্দ্রের ভেতরে কোনো বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে।
তবে ফায়ার সার্ভিস ও প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসায় স্থানীয়দের মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসে।
এক স্থানীয় ব্যবসায়ী জানান, “আগুনের খবর শুনে আমরা ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু খুব অল্প সময়েই আগুন নিভে যায়। ফায়ার সার্ভিসের লোকজন অসাধারণ কাজ করেছেন।”
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র: একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। এটি পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুর এলাকায় অবস্থিত। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান “রোসাটম”-এর সহযোগিতায় এ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে।
দুটি ইউনিটে মোট ২,৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়।
প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ চালু হওয়ার কথা রয়েছে, যা জাতীয় গ্রিডে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে।
অগ্নিকাণ্ডের পর ভবিষ্যৎ করণীয়
ঘটনার পর বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন ও প্রকল্প ব্যবস্থাপনা নিরাপত্তা ব্যবস্থার পুনর্মূল্যায়ন শুরু করেছে।
অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জামগুলো পুনরায় পরীক্ষা করা হচ্ছে এবং নির্মাণ এলাকাগুলিতে ধূমপান নিষিদ্ধ করার বিষয়টি আরও কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড প্রকল্পের জন্য বড় কোনো হুমকি নয়, তবে এটি সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করে। ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে আরও সচেতনতা বাড়াতে হবে।”
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি বড় দুর্ঘটনায় রূপ না নেওয়ায় স্বস্তি ফিরেছে সারাদেশে।
ফায়ার সার্ভিস, প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীর দ্রুত সমন্বিত পদক্ষেপ বাংলাদেশের দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে।
বর্তমানে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে, এবং প্রকল্পের কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলমান রয়েছে।
MAH – 13656 I Signalbd.com



