বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন আরও ঐক্যবদ্ধ, শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং ভ্রাতৃত্ববোধে দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে বলে জানিয়েছেন সদর দপ্তর আর্মি ট্রেনিং অ্যান্ড ডকট্রিন কমান্ড (আর্টডক)-এর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. মাইনুর রহমান।
তিনি বলেন, সেনাবাহিনী দেশের স্থিতিশীলতা, শান্তি ও জনগণের নিরাপত্তা রক্ষায় সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব বজায় রেখে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। জাতির আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনই তাদের প্রধান অঙ্গীকার।
সেনাসদরে সংবাদ সম্মেলনে আত্মবিশ্বাসী বক্তব্য
বুধবার (৫ নভেম্বর) সকালে ঢাকা সেনানিবাসের অফিসার্স মেস ‘এ’-তে আয়োজিত সেনাসদরের এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং সেনাবাহিনীর দায়িত্ব নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার প্রেক্ষাপটে এই সংবাদ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সেনাবাহিনীর মিলিটারি অপারেশনস ডিরেক্টরেটের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল দেওয়ান মোহাম্মদ মনজুর হোসেনসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাইনুর রহমান বলেন,
“গত ১৫ মাস আমরা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং সময় পার করেছি। দেশের ভেতরে ও বাইরে নানা প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে সেনাবাহিনীর প্রত্যেক সদস্য নিজেদের শৃঙ্খলা, দায়িত্ববোধ এবং পেশাদারিত্বের মাধ্যমে প্রমাণ করেছে—বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সব সময়ই দেশের জনগণের সেনাবাহিনী।”
“আমরা আরও ঐক্যবদ্ধ, আরও দৃঢ়”
তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলেন,
“আমি সবাইকে আশ্বস্ত করতে চাই—বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্য সেনাপ্রধান ও সিনিয়র নেতৃত্বের প্রতি শতভাগ অনুগত। আজকের সেনাবাহিনী আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ, সংগঠিত এবং ভ্রাতৃত্ববোধে অটুট।”
তার বক্তব্যে জোর দিয়ে বলা হয়, কিছু মহল বা ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেনাবাহিনীকে নিয়ে গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু এসব অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
তিনি বলেন, “আমরা জানি, কিছু স্বার্থান্বেষী চক্র সেনাবাহিনীর নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়। তবে আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, সেনাবাহিনীর মধ্যে কোনো বিভক্তি নেই, কোনো বিভ্রান্তি নেই। আমাদের লক্ষ্য একটাই—দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও শান্তি বজায় রাখা।”
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার নিয়ে কঠোর অবস্থান
সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেনাবাহিনীকে নিয়ে নানা ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জিওসি আর্টডক বলেন, “গুজব কখনোই সত্যকে আড়াল করতে পারে না। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সবসময় সত্য ও দেশের পাশে ছিল, আছে এবং থাকবে। আমরা আইন ও সংবিধানের অধীন থেকে দায়িত্ব পালন করি।”
তিনি গণমাধ্যম কর্মীদের অনুরোধ করে বলেন, “আপনারা যেন যাচাই না করে কোনো খবর প্রচার না করেন। কারণ একটি মিথ্যা তথ্যও সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে পারে।”
নির্বাচনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা ও প্রস্তুতি
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি প্রসঙ্গে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল দেওয়ান মোহাম্মদ মনজুর হোসেন বলেন, “নির্বাচন একটি সংবেদনশীল সময়। আমরা চাই, পুরো প্রক্রিয়া শান্তিপূর্ণ ও স্বচ্ছ হোক। এজন্য সেনাবাহিনী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে।”
তিনি জানান,
“নির্বাচনকালীন সময়ে প্রায় ৯০ হাজার থেকে এক লক্ষ সেনা সদস্য মাঠে থাকবে। এটি দেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ সেনা মোতায়েন। জেলা-উপজেলা এমনকি আসনভিত্তিক ক্যাম্প স্থাপন করে আমরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কাজ করব।”
ব্রিগেডিয়ার মনজুর আরও বলেন, “বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সরকারের নির্দেশনা ও নির্বাচন কমিশনের গাইডলাইন অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করবে। আমাদের একটাই লক্ষ্য—একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করা।”
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সেনাবাহিনীর পর্যবেক্ষণ
গত দুই দিনে কিছু জেলায় রাজনৈতিক সহিংসতার খবর পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ব্রিগেডিয়ার মনজুর বলেন,
“যখনই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হয়, তখনই সেনাবাহিনী সক্রিয় হয়। তবে এখনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সবসময় অন্যান্য বাহিনীকে সহযোগিতা করছে, যাতে কোথাও অস্থিরতা তৈরি না হয়।”
তিনি আরও বলেন, “আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেমন পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ সমন্বয় রয়েছে। আমরা একসঙ্গে কাজ করছি, যাতে সাধারণ মানুষ নিরাপদ বোধ করে।”
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানদের বৈঠক
সাম্প্রতিক সময়ে প্রধান উপদেষ্টা কার্যালয়ে তিন বাহিনীর প্রধানদের বৈঠক নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়ে সেনা কর্মকর্তারা জানান, বৈঠকে দেশের সার্বিক নিরাপত্তা ও নির্বাচনকালীন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
সেনাসদর জানিয়েছে, বৈঠকের সব তথ্য ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়েছে।
সেনাবাহিনী জনগণের পাশে থাকবে
লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাইনুর রহমান বলেন,
“বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শুধু একটি সামরিক বাহিনী নয়, এটি জনগণের আস্থা ও ভালোবাসার প্রতীক। দেশের যেকোনো দুর্যোগে, সংকটে এবং প্রয়োজনের সময় আমরা সবসময় জনগণের পাশে আছি। শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখাই আমাদের মূল লক্ষ্য।”
তিনি আরও বলেন, “দেশের উন্নয়ন, নিরাপত্তা ও অগ্রগতিতে সেনাবাহিনীর অবদান অনস্বীকার্য। আমরা চাই এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকুক। সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্য জানে—তাদের প্রথম দায়িত্ব দেশের জনগণ ও সংবিধানের প্রতি।”
বিশ্লেষণ: সেনাবাহিনীর ঐক্য বার্তা কেন গুরুত্বপূর্ণ
রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল সময়ের মধ্যে সেনাসদরের এই বক্তব্যকে বিশ্লেষকরা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে দেখছেন। কারণ সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেনাবাহিনী নিয়ে গুজব ও নানা বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চলছিল।
এই প্রেক্ষাপটে ‘আরও ঐক্যবদ্ধ’ সেনাবাহিনীর বার্তা জনগণের কাছে আস্থা ফিরিয়ে আনবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক আবদুল হাকিম বলেন,
“বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের অন্যতম স্থিতিশীল প্রতিষ্ঠান। তাদের ঐক্য ও শৃঙ্খলার ওপরই রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নির্ভর করে। সেনাসদরের এমন আত্মবিশ্বাসী বার্তা জনমনে স্থিতি আনবে।”
অন্যদিকে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) রাশেদুল হক বলেন,
“যখন রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়ে, তখন বাহিনীর ভিতরে ঐক্য বজায় রাখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেনাসদরের বক্তব্য প্রমাণ করে, নেতৃত্ব ও সদস্যদের মধ্যে কোনো বিভাজন নেই।”
উন্নয়ন ও শান্তির ধারায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শুধু সীমান্ত বা যুদ্ধকালীন দায়িত্বেই নয়, বরং দেশের উন্নয়ন, অবকাঠামো নির্মাণ, দুর্যোগ মোকাবিলা, শান্তিরক্ষা মিশন—সবক্ষেত্রেই অবদান রেখে চলেছে।
বর্তমানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সেনারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করছে, এবং বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে অন্যতম শীর্ষ শান্তিরক্ষী দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে।
সেনাসদরের এক কর্মকর্তা বলেন,
“দেশে যেমন আমরা জনগণের নিরাপত্তায় কাজ করছি, তেমনি বিশ্বের শান্তি রক্ষায়ও বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করছি। এটাই আমাদের গর্ব।”
লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাইনুর রহমানের বক্তব্যে একটি বিষয় স্পষ্ট—বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আজ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ, শক্তিশালী এবং জনবান্ধব।
দেশের আইনশৃঙ্খলা, স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া রক্ষায় তাদের ভূমিকা ভবিষ্যতেও গুরুত্বপূর্ণ থাকবে।
সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব জনগণের প্রতি যে আস্থা ও দায়বদ্ধতার বার্তা দিয়েছেন, তা দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা আনতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন অনেকেই।
MAH – 13634 I Signalbd.com



