বাংলাদেশি অভিবাসীরা রাশিয়ায় বৈধভাবে চাকরির উদ্দেশ্যে গিয়েছিলেন, কিন্তু এখন তারা যুদ্ধক্ষেত্রে অংশ নিতে বাধ্য হচ্ছেন। এই ভয়ঙ্কর বাস্তবতার শিকার হয়ে থাকা কমপক্ষে ১০ জন বাংলাদেশির পরিবার এখন তাদের প্রিয়জনদের নিরাপদে দেশে ফেরানোর চেষ্টা চালাচ্ছে।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির সর্বশেষ প্রতিবেদনে এমন তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ ধরনের ঘটনার সংখ্যা আরও বেশি, তবে সঠিক পরিসংখ্যান জানা সম্ভব নয়।
গত সোমবার ব্র্যাকের প্রকাশিত ‘প্রমিসেস রিটেন ইন ব্লাড: হাউ লিগ্যাল মাইগ্রেশন টার্নড ইনটু ফোর্সড রিক্রুটমেন্ট ইন দ্য রাশিয়া-ইউক্রেন ওয়ার’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এই বিষয়টি বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে। প্রতিবেদনে ইউক্রেন থেকে বেঁচে ফেরা ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার, পরিবারের বিবরণ এবং প্রাসঙ্গিক নথিপত্র যাচাইয়ের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, কীভাবে কিছু দালাল উচ্চ বেতনের চাকরির মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে শ্রমিকদের ফাঁদে ফেলে। অনেকেই তেল, নির্মাণ, বা লজিস্টিকস খাতে কাজের আশায় রাশিয়ায় গিয়েছিলেন। কিন্তু রাশিয়ায় পৌঁছানোর পর তাঁদের পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়।
ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক (অভিবাসন ও যুব) শরিফুল হাসান জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত ১০টি পরিবার তাদের স্বজনদের রাশিয়া থেকে ফেরত আনার জন্য ব্র্যাকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। এই সব ব্যক্তি বৈধ ভিসা নিয়ে রাশিয়ায় গিয়েছিলেন।
বাংলাদেশিরা সাধারণত সাত থেকে আট লাখ টাকা খরচ করে রাশিয়ায় গিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় দালাল এবং আন্তর্জাতিক সহায়তাকারীরাও জড়িত। তিনি আরও বলেন, “রাশিয়ায় কত শ্রমিক এভাবে যুদ্ধে যেতে বাধ্য হচ্ছেন, কতজন দেশে ফিরতে পেরেছেন, কতজন মারা গেছেন—এই তথ্য এখনও সঠিকভাবে জানা যায়নি। সরকারকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে সতর্ক করতে হবে যেন কেউ প্রতারণার শিকার না হয় বা যুদ্ধ করতে বাধ্য না হয়।”
ফেসবুকে যুদ্ধের প্রলুব্ধতা
শরিফুল হাসান আরও জানিয়েছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একজন বাংলাদেশি রাশিয়ায় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করলে কী কী সুবিধা পাওয়া যায়, তা নিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন। এর ফলে অনেক নতুন অভিবাসী রাশিয়ায় যুদ্ধ করতে আগ্রহী হয়ে পড়ছেন।
ব্র্যাকের প্রতিবেদনে বাগেরহাটের অয়ন মণ্ডল এবং কুমিল্লার অমিত বড়ুয়া-এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তারা বৈধ ভিসা নিয়ে রাশিয়ায় গিয়েছিলেন। অয়নের শেষ বার্তা অনুযায়ী, তাকে ইউক্রেন সীমান্তের দিকে নেওয়া হচ্ছিল এবং এর পর থেকে তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। অমিত বড়ুয়া একটি ছবিতে রুশ সামরিক পোশাক পরে দেখা যায়। এরপর থেকে তার পরিবার তাকে খুঁজে পায়নি।
পরিবারগুলোর আকুতি ও উদ্ধার চেষ্টা
তরুণ আফজাল হোসেন মেরাজ ট্রাভেল এজেন্সি “ফ্রেন্ডশিপ অ্যান্ড কো-অপারেটিভ রিক্রুটমেন্ট” এর মাধ্যমে রাশিয়ায় গিয়েছিলেন। তার বাবা আলী হোসেন ২২ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন, যাতে ছেলে দেশে ফেরত আনা হয়। তিনি অভিযোগ করেন, তার ছেলেকে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর কাছে বিক্রি করা হয়েছে। আফজাল তখন রাশিয়ার হয়ে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান করছিলেন।
ময়মনসিংহের আলী হোসেন প্রথম আলোকে জানান, তার ছেলে দুই মাস আগে মস্কোর বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তায় দেশে ফিরতে পেরেছেন। তিনি জানান, প্রথমে যে কোম্পানির চাকরির প্রলোভনে নেওয়া হয়েছিল, সেখানে চার মাস চাকরি করার পর তাকে ছাঁটাই করা হয় এবং পরে চক্রের মাধ্যমে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়। সেখানে আফজাল মাইন বিস্ফোরণে আহত হন এবং ২৫ দিন হাসপাতালেও থাকতে হয়।
আন্তর্জাতিক ভিসা ও প্রতারণার চক্র
অভিবাসন খাতের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) এর নির্বাহী পরিচালক তাসনিম সিদ্দিকী জানিয়েছেন, রাশিয়ায় সরাসরি কাজের জন্য যাওয়ার পাশাপাশি ট্যুরিস্ট ভিসা, ওমরাহ ভিসার মাধ্যমে প্রথমে সৌদি আরবে পাঠানো হচ্ছে। পরে চুক্তি করা হয় এবং যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে বাধ্য করা হয়।
ভুক্তভোগীদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে রামরুর পক্ষ থেকে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে, যা তথ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাকে দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
মিডিয়ার প্রতিবেদন ও সরকারের পদক্ষেপ
১২ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, রাশিয়ায় গিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধে জড়ানো বাংলাদেশিদের পরিবারগুলি তাদের সন্তানদের খুঁজছে। প্রতিবেদন অনুসারে, রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধে পাঠানো যুবকদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। ২২ বছর বয়সী এক বাংলাদেশি তরুণের মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হওয়ায় বিষয়টি আরও উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে।
৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মোহাম্মদ রফিকুল আলম জানিয়েছিলেন, মানব পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে কয়েকজন বাংলাদেশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বাধ্য হয়ে অংশ নিয়েছেন। তিনি বলেন, মস্কোতে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাছে বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হয়েছে।
তিনি আরও জানিয়েছিলেন, এই ধরনের কাজের সঙ্গে জড়িত রিক্রুটিং ও ট্রাভেল এজেন্সির বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়েছে। রাশিয়ায় মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত চক্রের একজনও গ্রেপ্তার হয়েছে।
ভ্রমণ ভিসা ও সতর্কতা
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ায় গমনেচ্ছু ব্যক্তিদের এবং যাদের পাসপোর্টে বৈধ রাশিয়া ভিসা আছে, তাদের জন্য আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোতে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ব্র্যাক ও রামরুর প্রতিবেদন স্পষ্টভাবে দেখায়, বৈধ ভিসা নিয়ে গিয়েও কত শ্রমিক যুদ্ধক্ষেত্রে বাধ্য হয়েছেন। বাংলাদেশের পরিবারগুলি আজও তাদের প্রিয়জনদের নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য তৎপর। এই পরিস্থিতি শুধুমাত্র দেশের নয়, আন্তর্জাতিক সমাজেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
বাংলাদেশে অভিবাসন ও মানব পাচারের এই চক্রের মোকাবেলায় সরকারের পদক্ষেপের পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা এখন অপরিহার্য। শিক্ষিত, সচেতন এবং প্রস্তুত হওয়া নতুন প্রজন্মকে এই ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে।
MAH – 13629 I Signalbd.com



