বাংলাদেশ

‘ফ্ল্যাট আমরা কিনেছি, কিন্তু ব্যাংক এখন তার মালিক’: গোপন বন্ধকীতে প্রতারণার শিকার ক্রেতারা

Advertisement

রাজধানী ঢাকার অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার জীবনের সঞ্চয় ঢেলে এক টুকরো ছাদের স্বপ্ন পূরণ করতে চায়। কিন্তু সম্প্রতি সেই স্বপ্ন ভয়াবহ দুঃস্বপ্নে রূপ নিচ্ছে। আবাসন কোম্পানির কাছ থেকে ফ্ল্যাট কিনে বছরের পর বছর বসবাস করার পর হঠাৎই জানতে পারছেন — যে ফ্ল্যাটে তারা থাকছেন সেটি ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখা ছিল। কোম্পানির ঋণ খেলাপি হওয়ায় আদালত সেই ভবন নিলামে তোলার আদেশ দিয়েছে। একসময় নিজের কেনা ফ্ল্যাটের ভেতরেই ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকতে হচ্ছে মালিকদের।

গোপন বন্ধকীতে ফেঁসে যাচ্ছেন ক্রেতারা

ঢাকার অভিজাত অঞ্চল থেকে শুরু করে মিরপুর, রামপুরা, খিলখেত, উত্তরা — সর্বত্রই এখন এমন প্রতারণার অভিযোগ। ডেভেলপার কোম্পানিগুলো নির্মাণের আগে বা মাঝপথে ব্যাংকের কাছ থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নেয়, ভবন বা জমিকে বন্ধক রাখে। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তারা কখনও জানায় না ফ্ল্যাট ক্রেতাদের।

ফলাফল, কোম্পানি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে ব্যাংক আদালতের আশ্রয় নেয়। আদালত রায় দেয় ব্যাংকের পক্ষে, আর ভবনটি নিলামে বিক্রির নির্দেশ আসে। তখনই ক্রেতারা জানতে পারেন — তাদের ফ্ল্যাটের প্রকৃত মালিক আসলে ব্যাংক।

আইনি লড়াই ও সংখ্যা: প্রতারণার শিকার হাজারো ক্রেতা

হাইকোর্টের নথি অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ ধরনের প্রতারণার ঘটনায় ১,০৭৬টি রিট আবেদন হয়েছে। এসব মামলার সঙ্গে জড়িত ক্রেতাদের বিনিয়োগের পরিমাণ আনুমানিক ২,৫০০ কোটি টাকা। গত চার বছর ধরে এই ধরণের রিটের সংখ্যা বেড়েই চলেছে —

  • ২০২৪ সালে ৭৫৪টি রিট (১,০৫০ কোটি টাকার সম্পৃক্ততা)
  • ২০২৩ সালে ৮১৩টি রিট (১,০০০ কোটি টাকা)
  • ২০২২ সালে ৬১৮টি রিট (৮০০ কোটি টাকা)
  • ২০২১ সালে ৫৬৯টি রিট (৭৫০ কোটি টাকা)

রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) জানায়, তাদের কাছে জমা পড়েছে অন্তত ৩৪০টি প্রতারণার অভিযোগ, যার সঙ্গে যুক্ত গ্রাহকদের প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ।

ভুক্তভোগীর অভিজ্ঞতা: ‘নিজের ফ্ল্যাটে এখন ভাড়াটিয়া আমি’

উত্তরার ‘ব্রাইট সাউথ’ প্রকল্পের ক্রেতা ডা. রফিকুল বারী দেড় কোটি টাকা দিয়ে ১,২৫০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট কেনেন ২০২২ সালে। পরিবারসহ সুখে বসবাসও শুরু করেন। কিন্তু ২০২৩ সালের এক সকালে দেখেন তার ভবনে সোনালী ব্যাংকের নিলাম নোটিশ ঝুলছে।

তদন্তে জানা যায়, ব্রাইট ফিউচার হোল্ডিং নামের ডেভেলপার কোম্পানির চেয়ারম্যান ২০১২ সালেই ওই ভবন বন্ধক রেখে ২১ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছিলেন, যা কখনোই পরিশোধ করা হয়নি। ব্যাংক আদালতের রায়ে ভবনটি নিলামে তোলে।

রফিকুল বারী বলেন, “আমরা ফ্ল্যাট কিনেছি নিজের ঘরের আশায়। এখন শুনছি ব্যাংক মালিক। আমরা রিট করেছি, কিন্তু আদালতের রায় না আসা পর্যন্ত অনিশ্চয়তায় আছি।”

আরও এক ভুক্তভোগী রাফিউর রহমান বলেন, “আমি আমার কেনা ফ্ল্যাটেই এখন ভাড়া দিচ্ছি ব্যাংককে। তিনজন প্রতিবেশী চলে গেছেন, আমি এখনো ভাড়াটিয়া হয়ে আছি নিজের ঘরে।”

বিশেষজ্ঞদের মত: ব্যাংক ও ডেভেলপারদের যোগসাজশেই বাড়ছে বিপদ

রিহ্যাব সভাপতি মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, “ব্যাংক যখন কোনো সম্পত্তি বন্ধক নেয়, তখন সেখানে বন্ধকীর সাইনবোর্ড ঝুলানোর বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু অনেক সময় ব্যাংক ও ডেভেলপার কোম্পানি যোগসাজশে সেটি ঝুলায় না। ফলে ক্রেতারা অন্ধকারে থেকে যান।”

তিনি আরও বলেন, একজন সাধারণ ফ্ল্যাট ক্রেতার পক্ষে প্রতিটি ব্যাংকে গিয়ে যাচাই করা সম্ভব নয়। তাই সরকারের উচিত হবে বন্ধকীকৃত সম্পত্তির জন্য একটি কেন্দ্রীয় ডিজিটাল ডাটাবেইজ তৈরি করা। এতে ক্রেতারা সহজেই জানতে পারবেন জমি বা ফ্ল্যাট কোনো ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখা আছে কি না।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমানও স্বীকার করেন, “অনেক ব্যাংক নিয়মিত বন্ধকী সম্পত্তি পর্যবেক্ষণ করে না। এর ফলেই এমন প্রতারণা হচ্ছে। ব্যাংকগুলোরও দায়িত্ব আছে ক্রেতাদের স্বার্থ রক্ষায়।”

আইনি জটিলতা ও সরকারি অবস্থান

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, “যেসব কোম্পানির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তাদের নিবন্ধন বাতিল ও জরিমানা করা হয়।” তবে রিহ্যাবের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কামাল মাহমুদ বলেন, “প্রশাসনিক তদারকির ঘাটতি ও কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশের কারণেই অনেক প্রতারক কোম্পানি পার পেয়ে যায়।”

এদিকে, সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে যে তারা ডেভেলপারদের সঙ্গে যোগসাজশে বন্ধকী দলিলের তথ্য গোপন করে। তবে বাংলাদেশ রেজিস্ট্রেশন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তা শেখ কাউসার আহমেদ বলেন, “দলিল রেকর্ড একাধিক অফিসে সংরক্ষিত হয়। তাই সব পর্যায়ে যাচাই না করলে ভুল তথ্য পাওয়া সম্ভব।”

সমাধানের পথ: ক্রেতা সচেতনতা ও ডিজিটাল রেজিস্ট্রি জরুরি

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতারণা রোধে তিনটি পদক্ষেপ জরুরি —
১. প্রতিটি বন্ধকীকৃত ভবনের সামনে বাধ্যতামূলকভাবে দৃশ্যমান সাইনবোর্ড ঝুলানো।
২. একটি কেন্দ্রীয় সরকারি ডাটাবেইজে সব বন্ধকীকৃত সম্পত্তির তথ্য সংরক্ষণ।
৩. ক্রয়-বিক্রয়ের আগে অনলাইন যাচাই সিস্টেম চালু করা।

তাদের মতে, নাগরিকদের সচেতনতার পাশাপাশি প্রশাসনিক নজরদারি না বাড়ালে এই প্রতারণা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

বাংলাদেশের আবাসন খাত গত দুই দশকে যে দ্রুত বিকাশ ঘটিয়েছে, তা এখন কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে হুমকির মুখে। নিজের কেনা ফ্ল্যাটে থেকে ভাড়া দেওয়া কিংবা আদালতের দ্বারে দৌড়ানো — এ যেন অচেনা এক বাস্তবতা। ভুক্তভোগীদের প্রশ্ন একটাই: “ফ্ল্যাট আমরা কিনেছি, কিন্তু ব্যাংক এখন তার মালিক — এটা কেমন আইন?”

এম আর এম – ২০২৫,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button