বাংলাদেশ

‘আন্দোলনরত শিক্ষকরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তুলতে অবদান রাখবে’

Advertisement

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন ও ভাতার দাবিতে চলমান আন্দোলন দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। আন্দোলনের মাঝেও প্রধানমন্ত্রী নয়, দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক ইতিবাচক বার্তা দিয়েছেন।

তিনি আশা প্রকাশ করেছেন — “আন্দোলনরত শিক্ষকরা শিগগিরই শ্রেণিকক্ষে ফিরে এসে নব উদ্যমে শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলবেন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উন্নয়নে অবদান রাখবেন।”

মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে প্রকাশিত এক পোস্টে এই বার্তা জানানো হয়। বার্তায় তিনি শুধু শিক্ষকদের উদ্দেশ্যেই নয়, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা নিয়েও খোলামেলা মন্তব্য করেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান: ‘শিক্ষকদের দাবি যৌক্তিক, তবে বাস্তবতা ভিন্ন’

ফেসবুক পোস্টে উল্লেখ করা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার মনে করে শিক্ষকদের দাবি পুরোপুরি যৌক্তিক। তবে দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষে একসাথে সব দাবি পূরণ করা সম্ভব নয়।

পোস্টে বলা হয় —

“অন্তর্বর্তী সরকার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের দাবি যৌক্তিক বলে মনে করে। তবে মূল বেতনের ২০ শতাংশ বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির মতো সামর্থ্য এখনো অর্থনীতিতে আসেনি। তাই বাস্তবতার নিরিখে সরকারকে ধাপে ধাপে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।”

সরকারের এই বক্তব্যে বোঝা যায়, তারা শিক্ষকদের দাবি স্বীকার করছে কিন্তু দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক সক্ষমতার সীমাবদ্ধতাকেও বিবেচনায় নিচ্ছে।

ধাপে ধাপে বেতন বৃদ্ধির ঘোষণা

অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যেই শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি বিষয়ে একটি দুই ধাপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

  • প্রথম ধাপ: ২০২৫ সালের ১ নভেম্বর থেকে শিক্ষকদের মূল বেতনে সাড়ে ৭ শতাংশ (৭.৫%) বৃদ্ধি কার্যকর হবে।
  • দ্বিতীয় ধাপ: ২০২৬ সালের জুলাই মাস থেকে বাড়ি ভাতা আরও সাড়ে ৭ শতাংশ (৭.৫%) বাড়ানো হবে।

এই ঘোষণায় শিক্ষক সমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেউ এটিকে সরকারের সদিচ্ছার নিদর্শন বলে দেখছেন, আবার কেউ বলছেন, এই হার যথেষ্ট নয়।

শিক্ষক সমাজের প্রতিক্রিয়া

বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি, নন-এমপিও শিক্ষক সংগ্রাম পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা সরকারের ঘোষণার পর সংবাদ সম্মেলন ও সামাজিক মাধ্যমে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আব্দুল মালেক বলেন —

“আমরা দীর্ঘদিন ধরে ন্যায্য বেতন ও ভাতার দাবি জানিয়ে আসছি। সরকার কিছুটা সাড়া দিয়েছে, এটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে আমরা আশা করি, শিগগিরই পুরো দাবি পূরণ করা হবে।”

অন্যদিকে নন-এমপিও শিক্ষক সংগ্রাম পরিষদের নেতা মো. শামসুল আলম বলেন —

“এটি সমস্যার আংশিক সমাধান মাত্র। শিক্ষকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে আরও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ দরকার।”

ড. ইউনূসের কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসা

প্রধান উপদেষ্টা তার পোস্টে শিক্ষা উপদেষ্টা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি লিখেছেন —

“এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে শিক্ষা উপদেষ্টা ও সংশ্লিষ্ট সবাই অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। আমি তাদের সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।”

ড. ইউনূস আরও উল্লেখ করেন, শিক্ষকরা যদি শ্রেণিকক্ষে ফিরে গিয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করেন, তবে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী হবে। তিনি বলেন,

“শিক্ষকরাই জাতির প্রাণ। তাঁদের সহযোগিতা ছাড়া কোনো জাতির অগ্রগতি সম্ভব নয়।”

শিক্ষা আন্দোলনের পটভূমি

গত সেপ্টেম্বর থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষকরা আন্দোলনে নামেন। তাদের মূল দাবি ছিল —
১️⃣ এমপিওভুক্তদের বেতন ও ভাতা সরকারি স্কেলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা,
২️⃣ নন-এমপিও শিক্ষকদের দ্রুত এমপিওভুক্ত করা,
৩️⃣ অবসর সুবিধা ও চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধি,
৪️⃣ বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট পুনর্বহাল।

এই দাবিগুলো নিয়ে শিক্ষকরা ঢাকা ও বিভাগীয় শহরগুলোতে মানববন্ধন, অবস্থান ধর্মঘট ও কর্মবিরতি পালন করেন।

শিক্ষকরা দাবি করেন, নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বর্তমান বেতনে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেকেই বলেছেন, “আমরা জাতি গড়ার কারিগর, কিন্তু নিজেদের পরিবার চালানোই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।”

অর্থনীতির বাস্তবতা: সরকারের সীমাবদ্ধতা

অর্থনীতিবিদদের মতে, বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বাজেট ঘাটতি ও মুদ্রাস্ফীতির হার বিবেচনায় একসাথে সব বেতন বৃদ্ধি করা কঠিন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদেক আহমেদ বলেন —

“সরকারের জন্য শিক্ষক বেতন বৃদ্ধির দাবি নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের ভারসাম্য রাখতে গিয়ে ধাপে ধাপে সিদ্ধান্তই সবচেয়ে বাস্তবসম্মত।”

তিনি আরও বলেন, “শিক্ষকরা যদি শ্রেণিকক্ষে ফিরে আসেন, তবে শিক্ষার্থীরাও উপকৃত হবে, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখবে।”

শিক্ষা ব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তনের আশা

অন্তর্বর্তী সরকারের এই পদক্ষেপ শিক্ষা খাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনবে বলে আশা করছেন শিক্ষাবিদরা।

প্রফেসর সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন —

“এই সিদ্ধান্তে শিক্ষক সমাজের মধ্যে আস্থা ফিরবে। তবে শুধু বেতন বৃদ্ধি নয়, শিক্ষা ব্যবস্থার মানোন্নয়নেও সরকারকে আরও কাজ করতে হবে।”

এছাড়াও শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরাও এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। ঢাকার এক অভিভাবক বলেন —

“শিক্ষকদের আন্দোলনে আমাদের সন্তানদের পড়াশোনায় ক্ষতি হচ্ছিল। এখন যদি শিক্ষকরা ক্লাসে ফিরে আসেন, তাহলে আমরা সবাই উপকৃত হব।”

ড. ইউনূসের বার্তার তাৎপর্য

ড. মুহাম্মদ ইউনূস শুধু একজন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদই নন, তিনি সমাজ পরিবর্তনের অগ্রদূত। তাঁর বার্তা শিক্ষকদের প্রতি এক ধরণের আহ্বান —
“আপনারা জাতি গঠনের দায়িত্বে আছেন। আন্দোলন করুন, কিন্তু দায়িত্বও ভুলে যাবেন না।”

এই ভারসাম্যপূর্ণ বার্তায় অনেক শিক্ষক ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন। সামাজিক মাধ্যমে দেখা গেছে, অনেকে লিখেছেন —

“ড. ইউনূসের কথাগুলো আমাদের নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। আমরা দাবি আদায় করব, কিন্তু ক্লাসও চালিয়ে যাব।”

ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা

সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ২০২৬ সালের বাজেটে শিক্ষা খাতে আরও বরাদ্দ বাড়ানো হবে। পাশাপাশি নতুন শিক্ষা নীতিমালাও প্রণয়নাধীন রয়েছে, যেখানে শিক্ষক প্রশিক্ষণ, ডিজিটাল শিক্ষা ও বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত হবে।

আশার আলো

শিক্ষকদের আন্দোলন দেশের শিক্ষা খাতে এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছে — ন্যায্য দাবি ও দায়িত্ব একে অপরের পরিপূরক।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আশাবাদী বার্তা সেই দায়িত্ববোধকে আরও জাগ্রত করেছে।

তিনি যেমন বলেছেন —

“শিক্ষকরা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তুলবেন, আর সরকার তাদের পাশে থাকবে।”

দেশজুড়ে এখন একটাই প্রত্যাশা — আন্দোলনের পর এবার শিক্ষায় ফিরে আসুক স্থিতিশীলতা, ফিরে আসুক শিক্ষার্থীদের হাসি।

MAH – 13416 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button