বাংলাদেশ

সীমান্তে দুই মণ গাঁজাসহ দুই মাদক ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার

Advertisement

সীমান্তে পুলিশের বড় সফলতা

কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার কাশিপুর ঘুঘুরহাট তেলীপাড়া সীমান্ত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ গাঁজা পাচারের সময় দুই মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করেছে ফুলবাড়ী থানা পুলিশ। অভিযানে প্রায় দুই মণ (প্রায় ৮০ কেজি) গাঁজা উদ্ধার করা হয়েছে, সঙ্গে আটক করা হয়েছে একটি সিএনজি অটোরিকশা

এ ঘটনায় এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে এবং স্থানীয়দের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। পুলিশ বলছে, এই অভিযান ছিল সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম বড় মাদকবিরোধী অভিযান।

গ্রেপ্তার দুইজনের পরিচয়

পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন—
১. খোরশেদ আলম (৩৮), পিতা মরহুম রজব আলী, গ্রাম—বুদারবান্নী, সদর ইউনিয়ন, ফুলবাড়ী উপজেলা।
২. সফিকুল ইসলাম (৫০), পিতা মরহুম সমশের আলী, গ্রাম—বিদ্যাবাগীশ, একই ইউনিয়নের বাসিন্দা ও পেশায় সিএনজি চালক।

তারা দীর্ঘদিন ধরে সীমান্ত ঘেঁষে মাদক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন।

গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান

ফুলবাড়ী থানার মাদকবিরোধী টিম জানায়, শুক্রবার রাতে তারা গোপন সূত্রে তথ্য পান যে, ভারতের দিক থেকে একদল মাদক কারবারি সিএনজিতে করে বিপুল পরিমাণ গাঁজা বাংলাদেশে পাচার করার পরিকল্পনা করছে।

সংবাদ পেয়ে ওসি শওকত আলী সরকারের নেতৃত্বে একটি বিশেষ দল উত্তর কাশিপুর তেলীপাড়া গ্রামস্থ ঘুঘুরহাট–টু–নাগেশ্বরী পাকা সড়কে অবস্থান নেয়। রাত গভীর হলে সীমান্ত এলাকা দিয়ে একটি সিএনজি প্রবেশ করতে দেখে পুলিশ সেটি থামানোর নির্দেশ দেয়।

তবে চালক পালানোর চেষ্টা করলে পুলিশ ধাওয়া করে গাড়িটিকে থামায়। এ সময় সিএনজির ভেতর থেকে চারটি বড় বস্তায় মোড়ানো অবস্থায় গাঁজা উদ্ধার হয়। ঘটনাস্থলেই দুইজনকে আটক করা হয়, বাকিরা অন্ধকারের সুযোগে পালিয়ে যায়।

উদ্ধার ও জব্দ তালিকা

পুলিশ জানায়, উদ্ধার করা গাঁজার মোট ওজন প্রায় দুই মণ (৭৮ কেজি ৪০০ গ্রাম)। প্রতিটি বস্তায় আলাদা করে প্যাকেটজাত করা ছিল গাঁজাগুলো, যা ভারতের কোচবিহার জেলা থেকে আনা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এছাড়া ঘটনাস্থল থেকে একটি সবুজ রঙের সিএনজি অটোরিকশা, দুটি মোবাইল ফোন, নগদ কিছু টাকা ও পাচারে ব্যবহৃত কাপড়ের বস্তা জব্দ করা হয়েছে।

পুলিশের বক্তব্য

ফুলবাড়ী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শওকত আলী সরকার জানান,

“আমাদের কাছে আগে থেকেই তথ্য ছিল যে এই সীমান্তপথটি মাদক পাচারের জন্য ব্যবহার করা হয়। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমরা এলাকাটিতে নজরদারি বাড়িয়েছিলাম। অবশেষে শুক্রবার রাতে সফল অভিযান চালিয়ে দুইজনকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে। উদ্ধার করা গাঁজার বাজারমূল্য আনুমানিক দেড় কোটি টাকা।”

তিনি আরও বলেন,

“গ্রেপ্তারকৃতদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, তারা সীমান্তের ওপারে থাকা এক ভারতীয় নাগরিকের কাছ থেকে নিয়মিত গাঁজা সংগ্রহ করে দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করত। তাদের সঙ্গে আরও কয়েকজন সহযোগী জড়িত আছে, যাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।”

মাদকবিরোধী আইনে মামলা

ঘটনার পর পুলিশ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি মামলা দায়ের করেছে। এতে হাতেনাতে গ্রেপ্তার হওয়া দুইজনসহ মোট আটজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। রোববার সকালে গ্রেপ্তারকৃতদের কুড়িগ্রাম আদালতে প্রেরণ করা হয়।

পুলিশ জানিয়েছে, মামলায় নাম উল্লেখ না থাকলেও তদন্তের মাধ্যমে বাকি পাচারচক্রের সদস্যদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করা হবে।

সীমান্তজুড়ে মাদকের বিস্তার উদ্বেগজনক

উত্তরাঞ্চলের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে মাদক পাচার দীর্ঘদিন ধরেই একটি বড় সমস্যা। ভারতের কোচবিহার, দার্জিলিং, আসাম ও মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষা বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও জেলার বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে নিয়মিতভাবে গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য দেশে প্রবেশ করছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারির পরও পাচারকারীরা নতুন নতুন পথ ব্যবহার করে মাদক আনছে। বিশেষ করে ফুলবাড়ী, নাগেশ্বরী ও ভূরুঙ্গামারী উপজেলার কয়েকটি সীমান্ত এলাকা এখন মাদক কারবারিদের নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত হয়েছে বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন।

স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া

অভিযানের পর স্থানীয়দের মধ্যে স্বস্তি দেখা দিয়েছে। তেলীপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আজহারুল ইসলাম বলেন,

“আমরা অনেক দিন ধরে দেখছি, রাতে কিছু মোটরসাইকেল ও সিএনজি সীমান্তের দিকে যায়। সন্দেহ করলেও কিছু বলার সাহস পাইনি। এবার পুলিশ যেভাবে অভিযান চালিয়েছে, তাতে আমরা আশাবাদী যে মাদক ব্যবসা বন্ধ হবে।”

স্থানীয় স্কুলশিক্ষিকা মমতাজ বেগম বলেন,

“মাদক শুধু যুবসমাজকেই ধ্বংস করছে না, পুরো সমাজকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। পুলিশ নিয়মিত অভিযান চালালে অন্তত কিছুটা স্বস্তি মিলবে।”

সীমান্তে মাদক প্রতিরোধে নতুন উদ্যোগ

সীমান্ত এলাকায় মাদক নিয়ন্ত্রণে এখন যৌথ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ফুলবাড়ী থানা সূত্রে জানা যায়, বিজিবি, পুলিশ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে “সীমান্ত মাদক প্রতিরোধ কমিটি” গঠন করা হয়েছে।

এই কমিটি নিয়মিতভাবে সচেতনতামূলক সভা করছে, যাতে স্থানীয় যুবকদের মাদক থেকে দূরে রাখা যায় এবং পাচারকারীদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে ওঠে।

ওসি শওকত আলী সরকার বলেন,

“আমরা শুধু আইন প্রয়োগ করছি না, পাশাপাশি মানুষকে সচেতন করতেও কাজ করছি। মাদক ব্যবসায় জড়িতদের আমরা কোনোভাবেই ছাড় দেব না।”

মাদকবিরোধী অভিযানে সাফল্য ও চ্যালেঞ্জ

গত ছয় মাসে কুড়িগ্রাম জেলায় প্রায় ২৫০ কেজি গাঁজা, ৩০ হাজার ইয়াবা ও বিপুল ফেনসিডিল উদ্ধার করেছে পুলিশ ও বিজিবি। তবে মাদক চক্রগুলো সীমান্তের ভেতরে-বাইরে এমনভাবে ছড়িয়ে আছে যে, তাদের পুরোপুরি নির্মূল করা এখনো কঠিন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, প্রতিটি অভিযানে স্থানীয়দের সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় তথ্যের অভাবে বড় বড় চক্র ধরা পড়ে না।

বিশেষ প্রতিবেদক মতামত

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুধু পুলিশের অভিযান নয়, মাদকবিরোধী শিক্ষা ও সচেতনতা বাড়ানোই এখন জরুরি। স্কুল, কলেজ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত আলোচনা আয়োজন করা দরকার, যাতে নতুন প্রজন্ম বুঝতে পারে—মাদক কেবল অপরাধ নয়, এটি জাতির ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ হুমকি।

ফুলবাড়ীর এই অভিযান প্রমাণ করেছে, তথ্যনির্ভর ও সাহসী পদক্ষেপ নিলে মাদক কারবারিদের ধরতে কষ্ট হয় না। তবে অভিযান যেন কেবল একদিনের না হয়, তা নিশ্চিত করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।

মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি দরকার জনসচেতনতা, সামাজিক প্রতিরোধ এবং বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ। তাহলেই হয়তো ভবিষ্যতে “দুই মণ গাঁজা উদ্ধার” নয়, “ফুলবাড়ী মাদকমুক্ত উপজেলা” শিরোনাম দেখতে পাব আমরা।

MAH – 13387 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button