বাংলাদেশ

তরুণ কৃষি-উদ্যোক্তাদের জন্য সামাজিক ব্যবসা তহবিল গঠনের আহ্বান

Advertisement

বাংলাদেশের কৃষি এখন শুধু খাদ্য উৎপাদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি এখন কর্মসংস্থান, উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও বৈদেশিক আয়ের বড় উৎসে পরিণত হয়েছে। সেই কৃষিক্ষেত্রেই এবার নতুন আশার আলো জ্বালালেন নোবেল বিজয়ী ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিলের (IFAD) সঙ্গে বৈঠকে তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা, নারী ও ক্ষুদ্র কৃষকদের সহায়তার জন্য একটি “সামাজিক ব্যবসা তহবিল” গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন।

রোববার (১২ অক্টোবর ২০২৫) ইতালির রোমে অনুষ্ঠিত বিশ্ব খাদ্য ফোরামের এক পার্শ্ববৈঠকে এই প্রস্তাব তোলেন তিনি। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আইএফএডি প্রেসিডেন্ট আলভারো লারিও, বাংলাদেশের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতারসহ বিভিন্ন দেশের কৃষি বিশেষজ্ঞরা।

সামাজিক ব্যবসা তহবিল: কী এবং কেন প্রয়োজন

অধ্যাপক ইউনূসের মূল প্রস্তাবের কেন্দ্রবিন্দু হলো — “সামাজিক ব্যবসা” ধারণা। এটি এমন এক বিনিয়োগ মডেল যেখানে লাভের লক্ষ্য নয়, বরং সমাজের সমস্যা সমাধানই মূল উদ্দেশ্য। অর্থাৎ, ব্যবসা হবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, কিন্তু লাভের টাকা মালিকের পকেটে যাবে না — বরং পুনরায় বিনিয়োগ হবে সমাজের উন্নয়নে।

তিনি বলেন,

“আমি এমন একটি তহবিল গঠনের আহ্বান জানাচ্ছি, যা দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্যসেবা, তরুণ উদ্যোক্তাদের নতুন উদ্যোগ, নারী কৃষক ও মৎস্য খাতের কর্মীদের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।”

বাংলাদেশের মতো কৃষিনির্ভর দেশে এই ধরনের উদ্যোগ কৃষি অর্থনীতি, খাদ্য নিরাপত্তা ও গ্রামীণ উদ্যোক্তা বিকাশে বিপ্লব ঘটাতে পারে।

বৈঠকের মূল আলোচ্য বিষয়

রোমের বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস ও আইএফএডি প্রেসিডেন্ট লারিওর মধ্যে বিভিন্ন কৌশলগত বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু দিক হলো:

  • গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণের নতুন শিল্প গড়ে তোলা
  • আম ও কাঁঠাল রপ্তানির বাজার সম্প্রসারণ
  • জলবায়ু-সহনশীল কৃষি উদ্যোগের বিকাশ
  • মহিষের দুধ থেকে মোজারেলা চিজসহ উচ্চমানের দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন
  • প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ ও বিনিয়োগ সহযোগিতা বৃদ্ধি

অধ্যাপক ইউনূস আইএফএডি প্রেসিডেন্টকে বাংলাদেশ সফরে আমন্ত্রণ জানান এবং বলেন,

“বাংলাদেশে কৃষি, সামাজিক ব্যবসা ও প্রযুক্তিতে সহযোগিতার বিস্তর সুযোগ রয়েছে। একটি প্রতিনিধি দল এসে এগুলো যাচাই করলে আরও কার্যকর পরিকল্পনা তৈরি করা সম্ভব।”

আইএফএডির আগ্রহ ও বাংলাদেশের সম্ভাবনা

আইএফএডি প্রেসিডেন্ট আলভারো লারিও বৈঠকে জানান,

“বাংলাদেশের সঙ্গে সামাজিক ব্যবসা উদ্যোগে অংশীদার হতে আমরা আগ্রহী। বর্তমানে আমরা দেশের কৃষি খাতে অর্ধডজনের বেশি প্রকল্পে অর্থায়ন করছি।”

১৯৭৮ সাল থেকে বাংলাদেশে আইএফএডি ৩৭টি প্রকল্পে অংশীদার হয়েছে, যার মোট মূল্য ৪.২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, এর মধ্যে ১.১৩ বিলিয়ন ডলার সরাসরি আইএফএডির বিনিয়োগ। বর্তমানে প্রায় ৪১২ মিলিয়ন ডলারের ছয়টি প্রকল্প চলমান রয়েছে, আরও একটি নতুন প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায়।

বাংলাদেশি ফল ও দুগ্ধ পণ্য: নতুন রপ্তানি সম্ভাবনা

অধ্যাপক ইউনূস বলেন,

“আমরা ইতোমধ্যে আম রপ্তানি শুরু করেছি, তবে পরিমাণ এখনও কম। চীন আমাদের কাছ থেকে আম ও কাঁঠাল আমদানিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এখন দরকার বৃহৎ পরিসরে প্রক্রিয়াজাতকরণ ও হিমাগার স্থাপন।”

বাংলাদেশের ফল রপ্তানির বাজারে এখন ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার বড় অংশ রয়েছে। সঠিক সংরক্ষণ ও মান বজায় রাখা গেলে বাংলাদেশের ট্রপিক্যাল ফল আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত হতে পারে।

অন্যদিকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার জানান,
বাংলাদেশি নারী উদ্যোক্তারা এখন মহিষের দুধ থেকে মোজারেলা চিজ তৈরি শুরু করেছেন। এটি কেবল স্থানীয় বাজারে নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও বিপুল সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
তিনি ইফাদের সহযোগিতা কামনা করে বলেন,

“আমরা চাই বাংলাদেশে পনির ও অন্যান্য দুগ্ধজাত পণ্যের উৎপাদন বাড়াতে ইফাদ আমাদের পাশে থাকুক।”

গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণ: অনাবিষ্কৃত সম্পদ

বাংলাদেশের মৎস্য খাত দেশের মোট রপ্তানি আয়ের অন্যতম উৎস হলেও, গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার ক্ষেত্রে এখনো বিশাল সম্ভাবনা অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন,

“আমাদের জেলেরা এখনো অগভীর পানিতে মাছ ধরেন, কারণ তাদের বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব রয়েছে। আইএফএডি যদি এই খাতে অর্থায়ন ও প্রযুক্তি সহায়তা দেয়, তাহলে বাংলাদেশের সমুদ্র অর্থনীতি নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে।”

বর্তমানে বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চলে ৫০০-র বেশি প্রজাতির মাছ রয়েছে, যার মধ্যে অনেকগুলো উচ্চমূল্যের সামুদ্রিক মাছ — যেমন টুনা, গ্রুপার, স্ন্যাপার প্রভৃতি। সঠিক প্রযুক্তি ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন নৌযান ব্যবহারে এই শিল্প হতে পারে ‘নীল অর্থনীতি’র নতুন স্তম্ভ।

নারী ও তরুণ উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ: সামাজিক পরিবর্তনের চালিকা শক্তি

অধ্যাপক ইউনূস সবসময়ই নারীর ক্ষমতায়ন ও তরুণ উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করেছেন।
তিনি মনে করেন, “যদি তরুণরা কৃষিকে আধুনিক ব্যবসা হিসেবে নেয়, তাহলে গ্রামের অর্থনীতি স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে।”

বাংলাদেশের বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ কৃষি খাতে নিয়োজিত, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ নারী।
সামাজিক ব্যবসা তহবিল গঠিত হলে তারা সহজ শর্তে পুঁজির যোগান পাবেন, নতুন প্রযুক্তি শিখবেন এবং নিজস্ব পণ্য বাজারজাত করতে পারবেন।

জলবায়ু-সহনশীল কৃষি: ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ ও পথনির্দেশ

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে খরা, লবণাক্ততা ও বন্যা কৃষি উৎপাদনকে হুমকির মুখে ফেলছে।
এই প্রেক্ষাপটে অধ্যাপক ইউনূস ও আইএফএডির আলোচনায় “জলবায়ু-সহনশীল কৃষি উদ্যোক্তা” তৈরির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।

এ ধরনের উদ্যোগের মাধ্যমে কৃষকরা

  • খরা সহনশীল ফসল উৎপাদন,
  • আধুনিক সেচ প্রযুক্তি ব্যবহার,
  • জৈব সার ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি প্রয়োগ করতে পারবেন।

এই প্রচেষ্টা টেকসই কৃষি ব্যবস্থার দিকেই নিয়ে যাবে বাংলাদেশকে।

বিশ্ব প্রেক্ষাপটে ইউনূসের উদ্যোগ

বিশ্বজুড়ে “সোশ্যাল বিজনেস মডেল” ইতিমধ্যেই আলোচিত।
ইউনূস সেন্টার, গ্রামীণ ব্যাংক, এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তার প্রতিষ্ঠিত উদ্যোগ যেমন গ্রামীণ-ড্যানোন, গ্রামীণ-ভেওলিয়া, ও গ্রামীণ-ইউনিলিভার দেখিয়েছে — সামাজিক ব্যবসা শুধু দরিদ্রতার বিরুদ্ধে নয়, বরং এটি মানবিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার কার্যকর মডেল।

এই প্রেক্ষাপটে তরুণ কৃষকদের জন্য আলাদা তহবিল গঠন করা মানে হলো, বাংলাদেশকে বিশ্ব কৃষি-উদ্যোক্তা বিপ্লবের সামনের সারিতে নিয়ে আসা।

সরকারি সহযোগিতা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন
খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার,
এসডিজি সমন্বয়কারী লামিয়া মোর্শেদ,
পররাষ্ট্র সচিব আসাদ আলম সিয়াম,
এবং আইএফএডির সহযোগী সহ-সভাপতি ডোনাল ব্রাউন।

তারা একমত হন যে, বাংলাদেশের কৃষি খাত এখন রূপান্তরের দ্বারপ্রান্তে
প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ, বিনিয়োগ ও উদ্ভাবনের সমন্বয়ে গড়ে উঠতে পারে এমন একটি কৃষি অর্থনীতি, যা শুধু দেশ নয়, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের মর্যাদা বাড়াবে।

নতুন প্রজন্মের হাতে টেকসই কৃষির ভবিষ্যৎ

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের প্রস্তাব কেবল একটি অর্থনৈতিক উদ্যোগ নয়; এটি একটি সামাজিক আন্দোলন, যার লক্ষ্য স্বনির্ভর কৃষি, তরুণ উদ্যোক্তার বিকাশ ও দারিদ্র্য দূরীকরণ।

এই সামাজিক ব্যবসা তহবিল বাস্তবায়িত হলে,

  • তরুণরা কৃষিতে ফিরে আসবে,
  • গ্রামীণ অর্থনীতি হবে সক্রিয়,
  • নারীরা হবে স্বাবলম্বী,
  • আর বাংলাদেশ পাবে এক নতুন কৃষি-বিপ্লবের সূচনা।

MAH – 13295 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button