বিশ্ব

হঠাৎ উত্তাল ভারতের ‘লাদাখে’ কী হচ্ছে, আন্দোলন কেন সহিংসতায় রূপ নিল

Advertisement

ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল লাদাখের রাজধানী লেহতে রাজ্যের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের আওতাভুক্তির দাবিতে চলমান আন্দোলন বুধবার সহিংসতায় রূপ নেয়। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে অন্তত চারজন নিহত এবং অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে সাধারণ মানুষ ছাড়াও একাধিক পুলিশ সদস্য রয়েছেন।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রশাসন শহরজুড়ে কারফিউ জারি করেছে। পাঁচজনের বেশি মানুষের জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং সব ধরনের সমাবেশের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।

বিক্ষোভে সহিংসতার চিত্র

স্থানীয় প্রশাসন ও প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, আন্দোলনকারীরা প্রথমে শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান নিলেও পরে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। উত্তেজিত জনতা স্থানীয় বিজেপি অফিসে আগুন লাগায় এবং একটি সরকারি গাড়িও ভাঙচুর করে। এর পরেই পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও লাঠিচার্জ শুরু করে।

আহতদের মধ্যে অনেকে গুরুতর অবস্থায় স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। প্রশাসনের দাবি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া তাদের কোনো বিকল্প ছিল না।

আন্দোলনের পেছনের দাবিগুলো

বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিচ্ছে লেহ অ্যাপেক্স বডি (এলএবি) এর যুব শাখা। তাদের মূল দাবি—

  • লাদাখকে রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া
  • সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা
  • স্থানীয় জনগণের ভূমি ও সংস্কৃতির সুরক্ষা
  • নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ

এলএবি সভাপতি থুপস্তান সোয়াং বলেন, “আমরা দীর্ঘদিন ধরে এই দাবিগুলো তুলে আসছি। কিন্তু সরকারের উদাসীনতায় আমাদের তরুণদের প্রাণ দিতে হলো। আমরা এই ত্যাগ বৃথা যেতে দেব না।”

লাদাখের পটভূমি ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

২০১৯ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত লাদাখ জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের অংশ ছিল। সেদিন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে রাজ্য বিভক্ত করে লাদাখকে পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করে। শুরুতে এই সিদ্ধান্তকে অনেকেই স্বাগত জানিয়েছিলেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে স্থানীয় জনগণের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়।

রাজ্যের মর্যাদা হারিয়ে লাদাখ সরাসরি দিল্লির নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় স্থানীয়দের রাজনৈতিক অধিকার, ভূমি মালিকানা ও কর্মসংস্থান নিয়ে উদ্বেগ বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে এই অসন্তোষ আন্দোলনের রূপ নেয়।

সহিংসতার সূত্রপাত ও প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া

শান্তিপূর্ণ অনশন থেকে শুরু হওয়া এই আন্দোলনকে সম্প্রতি নেতৃত্ব দেন খ্যাতিমান পরিবেশ কর্মী সোনম ওয়াংচুক। তিনি ও তার সহযোগীরা ১০ সেপ্টেম্বর থেকে অনশনে বসেন। অনশনের একপর্যায়ে কয়েকজনের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে আন্দোলনকারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।

বুধবারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে জনতা রাস্তায় নেমে আসে। একসময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে। পুলিশ দাবি করছে, আন্দোলনকারীদের মধ্যে একটি অংশ আগে থেকেই সহিংসতার পরিকল্পনা করেছিল।

অন্যদিকে আন্দোলনকারীদের বক্তব্য, পুলিশের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের কারণেই পরিস্থিতি সহিংস হয়ে ওঠে।

সরকারের অবস্থান ও দোষারোপ

ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, “বহুবার আহ্বান জানানো সত্ত্বেও সোনম ওয়াংচুক অনশন বন্ধ করেননি এবং উসকানিমূলক ভাষণ দিয়েছেন। তার বক্তব্যে প্রভাবিত হয়েই আন্দোলনকারীরা সহিংসতার পথে যায়।”

সরকারের অভিযোগ, ওয়াংচুক বিদেশি আন্দোলনের উদাহরণ টেনে স্থানীয় জনগণকে ভুল বার্তা দিয়েছেন। তবে ওয়াংচুক নিজে টুইট বার্তায় সহিংসতার নিন্দা জানিয়ে বলেন, “এই সহিংসতায় আমাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমি যুব সমাজকে শান্তিপূর্ণ পথে ফেরার আহ্বান জানাই।”

স্থানীয় জনগণের উদ্বেগ ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টি

লাদাখের সাধারণ জনগণ বলছেন, তারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চান, কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত থাকার কারণে তরুণরা ক্ষোভে ফেটে পড়ছে। বিশেষ করে বেকারত্ব, অবকাঠামোগত উন্নয়নের ঘাটতি এবং ভূমির অধিকার সংক্রান্ত সমস্যাগুলো তাদের আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

এদিকে আন্তর্জাতিক মহলও লাদাখের পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছে। কারণ, লাদাখ কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এর একদিকে পাকিস্তান এবং অন্যদিকে চীনের সীমান্ত রয়েছে। তাই এখানে অস্থিরতা ভারতের জন্য শুধু অভ্যন্তরীণ সংকট নয়, আঞ্চলিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

সামনে কী হতে পারে

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, লাদাখের চলমান অস্থিরতা দ্রুত সমাধান না হলে তা আরও বিস্তৃত আকার নিতে পারে। একদিকে জনগণের ন্যায্য দাবি, অন্যদিকে কেন্দ্র সরকারের কঠোর অবস্থান—এই দ্বন্দ্ব থেকেই পরিস্থিতি আরও ঘনীভূত হচ্ছে।

স্থানীয় নেতৃত্ব চাইছে সরাসরি দিল্লির সঙ্গে আলোচনা, অন্যদিকে সরকার চাইছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখে ধাপে ধাপে সমাধান। এখন প্রশ্ন হলো—দুই পক্ষের মধ্যে আপস কতটা সম্ভব?

লাদাখের আন্দোলন নতুন কোনো ঘটনা নয়, তবে এবার তা সহিংস রূপ নিয়েছে। এতে যেমন প্রাণহানি ঘটেছে, তেমনি বাড়ছে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা। ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি নির্ভর করছে সরকারের উদ্যোগ ও আন্দোলনকারীদের অবস্থানের ওপর। শান্তিপূর্ণ আলোচনার পথ না খুললে এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি আরও বিস্তার লাভ করতে পারে।

এম আর এম – ১৫২০,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button