অর্থনীতি

জুলাই–আগস্টে বিদেশি ঋণ এল ৭৫ কোটি ডলার, গেল ৬৭ কোটি ডলার

Advertisement

চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই–আগস্ট) বাংলাদেশ বিদেশি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও দেশগুলোর কাছ থেকে প্রায় ৭৫ কোটি ডলার ঋণ গ্রহণ করেছে। তবে একই সময়ে আগের ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধে লেগেছে প্রায় ৬৭ কোটি ডলার। অর্থাৎ নতুন করে যত ডলার এসেছে, প্রায় পুরোটা দিয়েই পুরোনো ঋণ শোধ করতে হয়েছে।

আজ রোববার অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) জুলাই–আগস্ট মাসের বিদেশি ঋণ পরিস্থিতির হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ঋণ আসছে, তবে ঋণ শোধের বোঝাও একইসঙ্গে বেড়ে চলেছে।

ঋণ আসছে বেশি, শোধও বাড়ছে

ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, জুলাই–আগস্টে বিদেশ থেকে এসেছে ৭৫ কোটি ৬ লাখ ডলার। যা পুরোটাই ঋণ হিসেবে এসেছে। গত বছরের একই সময়ে ঋণ এসেছিল প্রায় ৪৬ কোটি ডলার। অর্থাৎ এক বছরে ঋণ প্রবাহ প্রায় ৬০ শতাংশ বেড়েছে।

তবে সুদ ও আসল মিলিয়ে পরিশোধ করতে হয়েছে ৬৬ কোটি ৭১ লাখ ডলার। এর মধ্যে আসল ঋণ ৪৮ কোটি ৮৭ লাখ ডলার এবং সুদ ১৭ কোটি ৮৩ লাখ ডলার। গত বছরের একই সময়ে ঋণ শোধ হয়েছিল প্রায় ৫৯ কোটি ডলার।

টাকার হিসাবে এ বছর শোধ হয়েছে ৮ হাজার ১৩১ কোটি টাকা, যেখানে আগের বছর জুলাই-আগস্টে পরিশোধ হয়েছিল প্রায় ৬ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র এক বছরে ঋণ শোধ বেড়েছে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা

ঋণের প্রতিশ্রুতি কমছে

বাংলাদেশ যে ঋণ পায়, তার বড় অংশ আসে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা যেমন—বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাইকা, আইডিএ, এবং বিভিন্ন দাতা দেশ থেকে। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে মাত্র ২৪ কোটি ডলারের নতুন ঋণ প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। গত বছর একই সময়ে প্রতিশ্রুতি ছিল ২০ কোটি ডলার।

এর মানে ঋণের প্রবাহ থাকলেও, নতুন প্রকল্পের জন্য বড় অঙ্কের প্রতিশ্রুতি এখনো সীমিত।

কেন বাড়ছে ঋণ শোধ?

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, বিগত এক দশকে বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক ঋণ নিয়েছে বিভিন্ন অবকাঠামো ও উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বন্দর উন্নয়নসহ বড় প্রকল্পে এসব ঋণের ব্যবহার হয়েছে।

এখন সেই ঋণগুলোর গ্রেস পিরিয়ড (সুদমুক্ত সময়) শেষ হয়ে গেছে। ফলে আসল ও সুদ পরিশোধের চাপ একসঙ্গে বাড়ছে। বিশেষ করে চীন, রাশিয়া ও ভারতের ঋণ তুলনামূলক উচ্চ সুদে নেওয়া হয়েছিল, যেগুলোর পরিশোধ শুরু হয়ে গেছে।

রিজার্ভ সংকটে বাড়তি চাপ

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন প্রায় ২৭ বিলিয়ন ডলার। কয়েক বছর আগেও রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়নের বেশি। আমদানি ব্যয়, ডলার সংকট এবং রপ্তানি আয়ে ধীরগতি মিলিয়ে রিজার্ভে চাপ তৈরি হয়েছে।

এই অবস্থায় বিদেশি ঋণ শোধ করতে হওয়ায় রিজার্ভ আরও দ্রুত কমছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, ঋণ শোধ যদি ঋণ গ্রহণের সমান হয়, তবে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা পরিস্থিতি স্থায়ীভাবে চাপের মধ্যে থাকবে।

বিদেশি ঋণ নির্ভরতা: আশীর্বাদ না অভিশাপ?

বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে বিদেশি ঋণকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রধান অর্থায়নের উৎস হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। উন্নয়ন সহযোগীরা তুলনামূলকভাবে স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিয়ে থাকে। এর ফলে অবকাঠামো উন্নয়নে গতি এসেছে।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে বেশি সুদে নেওয়া ঋণ ও বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির কারণে ঋণের বোঝা বাড়ছে। ঋণ–সুদ অনুপাত (Debt Service Ratio) ক্রমেই বাড়ছে, যা ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতামত

অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন,

“বাংলাদেশে এখন নতুন ঋণ এলেও, প্রায় সমপরিমাণ অর্থ ঋণ শোধে চলে যাচ্ছে। এর ফলে নেট সুবিধা খুব সীমিত। দীর্ঘমেয়াদে এ অবস্থা অর্থনীতির জন্য উদ্বেগজনক।”

অপর অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম বলেন,

“উচ্চ সুদে নেওয়া বাণিজ্যিক ঋণগুলো বাংলাদেশের জন্য বড় ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি রপ্তানি আয় না বাড়ে, তবে ঋণ শোধ করতে গিয়ে অর্থনীতি আরও চাপে পড়বে।”

সামনে কী হতে পারে?

বাংলাদেশ সরকারের লক্ষ্য, উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর সুফল পেলে অর্থনীতি গতি পাবে এবং রাজস্ব আয় বাড়বে। ফলে ঋণ শোধ সহজ হবে। তবে বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রা সংকট অব্যাহত থাকলে নতুন ঋণ নেওয়া ও পুরোনো ঋণ শোধ—দুটোই কঠিন হয়ে পড়বে।

সরকার ইতিমধ্যে আইএমএফ থেকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্যাকেজ নিচ্ছে, যা ডলার সংকট কাটাতে সহায়তা করছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু ঋণ নেওয়া নয়, বরং রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়াতে হবে।

বাংলাদেশ এখন এক জটিল আর্থিক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে বিদেশি ঋণের প্রবাহ বাড়ছে, অন্যদিকে ঋণ শোধের চাপও সমান তালে বাড়ছে। জুলাই–আগস্টের পরিসংখ্যান সেই বাস্তবতাকেই ফুটিয়ে তুলেছে।

দীর্ঘমেয়াদে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন চাইলে বাংলাদেশকে ঋণ নির্ভরতা কমিয়ে রপ্তানি, প্রবাসী আয় ও অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বাড়ানোর দিকে জোর দিতে হবে। না হলে বিদেশি ঋণ আশীর্বাদ নয়, বরং অর্থনীতির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

MAH – 13057 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button