রেলের সাবেক ডিজি তৌহিদুলসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা, ৬০০ কোটি টাকার ক্ষতি

বাংলাদেশ রেলওয়ে ইতিহাসে এক বিতর্কিত অধ্যায় হিসেবে রয়ে গেল ডেমু ট্রেন কেলেঙ্কারি। রাষ্ট্রীয় ৬০০ কোটি টাকার ক্ষতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে রেলের সাবেক মহাপরিচালক তৌহিদুল আনোয়ার চৌধুরীসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) দুদক সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, প্রায় ১০ বছর আগে চীনের থেকে ২০টি ডেমু ট্রেন আমদানি করে বাংলাদেশ সরকার। ২০১৫ সালের এই প্রকল্পে মোট ব্যয় হয়েছিল সাড়ে ৬০০ কোটি টাকা। কিন্তু ট্রেনগুলো মাত্র পাঁচ-ছয় মাসের মধ্যে বিকল হতে শুরু করে। নতুন প্রযুক্তির ট্রেন পরিচালনার জন্য যথাযথ জ্ঞান ও দক্ষ জনবল না থাকায় মেরামতের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে তিন বছর আগে এই ট্রেনগুলো স্থায়ীভাবে অচল হয়ে যায়।
রেলের সাবেক ডিজি তৌহিদুলসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ
মামলার এজাহারে বলা হয়, ডেমু ট্রেন প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সময়ে নিয়োগ ও আমদানিতে স্বচ্ছতার অভাব ছিল। ফলে রাষ্ট্রীয় সম্পদ দুর্নীতির শিকার হয়। মামলায় অভিযুক্ত সাতজন হলেন:
- তৌহিদুল আনোয়ার চৌধুরী – সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ রেলওয়ে
- প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী
- প্রকল্প পরিচালক
- রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা
- অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সংক্রান্ত কর্মকর্তা
- আমদানিতে জড়িত কর্মকর্তা
- চীনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগকারী ঠিকাদার প্রতিনিধি
দুদক সূত্রে জানা যায়, এই সাতজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি করার জন্য।
ডেমু ট্রেন প্রকল্প: পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের চরম ব্যর্থতা
ডেমু ট্রেন প্রকল্পটি মূলত শহর ও পার্শ্ববর্তী এলাকার যাত্রী পরিবহন সহজ করার উদ্দেশ্যে আনা হয়েছিল। ট্রেনগুলো ছিল আধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ। তবে চীনা প্রযুক্তি ও নতুন যন্ত্রাংশ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে রেলওয়ের যথাযথ প্রস্তুতি ছিল না।
- প্রযুক্তিগত সমস্যা: ট্রেনগুলোর ইঞ্জিন ও ব্রেকিং সিস্টেম অপ্রতুল মানের হওয়ায় দ্রুত বিকল হয়ে যায়।
- মানবসম্পদ সমস্যা: যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী না থাকায় মেরামতের কাজ ব্যর্থ হয়।
- পরিকল্পনার অভাব: ডেমু ট্রেনের পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছিল না।
ফলে, মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে ২০টি ট্রেনের মধ্যে অধিকাংশ অচল হয়ে যায়। তিন বছরের মধ্যে পুরো flotilla স্থায়ীভাবে ব্যবহার অযোগ্য হয়ে ওঠে।
রাষ্ট্রীয় ক্ষতির পরিমাণ
প্রথমদিকে ডেমু ট্রেন প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছিল প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। তবে প্রকল্প ব্যর্থ হওয়ায় কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, জনসাধারণের ভোগান্তিও বেড়ে গেছে।
- আর্থিক ক্ষতি: ৬০০ কোটি টাকা ব্যয়ের পর ট্রেন অচল।
- সেবা ব্যাঘাত: যাত্রী পরিবহন ব্যাহত।
- দুর্নীতির ইঙ্গিত: অভিযোগে বলা হয়েছে, প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ব্যক্তিগত স্বার্থে অনিয়ম করা হয়েছে।
স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ডেমু ট্রেন প্রকল্পে দুর্নীতির খবর প্রকাশের পর জনগণ, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক মহল এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ট্রেন আমদানির আগে যথাযথ পরিকল্পনা ও দক্ষ জনবল নিশ্চিত করা প্রয়োজন ছিল।
চীনা নির্মাতা সংস্থা ও বাংলাদেশ রেলওয়ের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি থাকা সত্ত্বেও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থার ত্রুটি প্রকল্প ব্যর্থ হওয়ার বড় কারণ।
মামলার পরবর্তী ধাপ
দুদক মামলাটি আদালতে প্রেরণ করেছে। মামলার তদন্তের অংশ হিসেবে:
- অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শোনানি নেওয়া হবে
- আর্থিক লেনদেনের বিস্তারিত খতিয়ান তৈরি করা হবে
- প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়কার নথি ও কন্ট্রাক্ট বিশ্লেষণ করা হবে
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মামলার সুষ্ঠু তদন্ত হলে ভবিষ্যতে এই ধরনের বড় প্রকল্পে দুর্নীতির সুযোগ কমবে।
ডেমু ট্রেন প্রকল্প: একটি শিক্ষা
ডেমু ট্রেন কেলেঙ্কারি শুধু আর্থিক ক্ষতির উদাহরণ নয়, এটি একটি শিক্ষণীয় ঘটনা। এখানে দেখা গেছে:
- পরিকল্পনার অভাব: প্রযুক্তি ও মানবসম্পদ অনুযায়ী প্রকল্প পরিকল্পনা জরুরি।
- স্বচ্ছতার অভাব: সরকারি প্রকল্পে স্বচ্ছতা ও নিয়মনীতি মানা অপরিহার্য।
- দূরদর্শিতা: নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের আগে প্রশিক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের স্থায়ী ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই ঘটনায় রেলওয়ের নতুন প্রজন্মের কর্মকর্তারা সতর্ক হবে এবং ভবিষ্যতে আরেকটি ব্যর্থ প্রকল্প এড়িয়ে যাবে।
ডেমু ট্রেন কেলেঙ্কারি বাংলাদেশের রেলওয়ের জন্য এক ব্যর্থ উদ্যোগ। ২০টি ট্রেন আমদানির পর মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে অচল হয়ে যায়। ৬০০ কোটি টাকার ক্ষতি এবং দায়মুক্তি নিয়ে সাবেক মহাপরিচালক তৌহিদুল আনোয়ার চৌধুরীসহ সাতজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। মামলার তদন্ত ও শোনানির মাধ্যমে প্রকৃত দায়ীদের সনাক্ত করা হবে।
রেলের আধুনিকায়ন, নাগরিকদের সেবা উন্নয়ন এবং দূর্নীতি দমন সংক্রান্ত এই ঘটনা বাংলাদেশের সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ।
MAH – 12864 Signalbd.com