মানুষ জন্মেছে উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য, চাকরির জন্য নয়

বাংলাদেশের খ্যাতনামা সমাজতাত্ত্বিক ও অর্থনীতিবিদ, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, মানুষ জন্মগ্রহণ করেছে উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য, কারো চাকরি করার জন্য নয়। তার মতে, উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিকতা এবং সৃজনশীল শক্তি মানুষকে সমাজ ও অর্থনীতিতে বিশেষভাবে অবদান রাখতে সক্ষম করে।
রোববার (১৪ সেপ্টেম্বর) সকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) ভবন-২ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরা, শিক্ষাবিদ, উদ্যোক্তা এবং সাংবাদিকবৃন্দ।
উদ্যোক্তাদের প্রতি আহ্বান
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “মানুষ কারো চাকরি করার জন্য আসেনি। মানুষের জন্ম হয়েছে উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত প্রতিটি মানুষকে তার নিজস্ব ক্ষমতা ও সৃজনশীলতার ভিত্তিতে কাজের সুযোগ দেওয়া। এটি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নেই নয়, বরং সমাজের সার্বিক উন্নয়নেও বিশেষ অবদান রাখে।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, বর্তমানে প্রযুক্তি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে এটি মানুষের দক্ষতা ও সৃজনশীলতাকে বিশ্বের সঙ্গে সহজেই সংযুক্ত করতে পারে। “প্রযুক্তি আমাদেরকে সকল কাজে, এমনকি সবচেয়ে দূরবর্তী অঞ্চলেও, একেবারে বিশ্বমানের সুযোগ এনে দিয়েছে। এখন প্রযুক্তির সুবিধা গ্রহণ করে উদ্যোক্তা হওয়ার সময় এসেছে,” যোগ করেন অধ্যাপক ইউনূস।
নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য সুযোগ
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “আজ মানুষ নানা ধরনের উদ্যোক্তা হয়েছে। আমরা কারও তালিকা রাখি না। অর্থাৎ, নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য সুযোগ সবসময়ই খোলা। যারা নতুন উদ্যোগে অংশগ্রহণ করতে চায়, তারা প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হতে পারছে এবং নতুন ধারণা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হচ্ছে।”
তিনি পিকেএসএফ-এর নতুন ভবনের কার্যক্রমকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, “এই নতুন ভবন আমাদেরকে নতুন পথের দিকে পরিচালিত করবে। আমরা চাই প্রতিটি মানুষ তার স্বপ্ন ও সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে যেখানে যেতে চায়, সেখানে যাওয়ার সুযোগ পাবে। পিকেএসএফ-এর এই নতুন যাত্রা আমাদের সেই লক্ষ্য পূরণে সহায়তা করবে।”
উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিকতা
অধ্যাপক ইউনূসের বক্তব্যে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে উদ্যোক্তা মানসিকতার দিকে। তিনি বলেন, “উদ্যোক্তা হওয়া মানে শুধু ব্যবসা করা নয়। এটি মানে সমস্যা সমাধানের নতুন উপায় খুঁজে বের করা, সমাজের জন্য নতুন সমাধান তৈরি করা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করা।”
তিনি আরো বলেন, বর্তমান বিশ্বের অর্থনীতি পরিবর্তনশীল। নতুন প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রভাব ফেলছে। “এতে শুধু ব্যবসা নয়, সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই নতুন উদ্ভাবন গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত মানুষকে তাদের সৃজনশীল ক্ষমতা কাজে লাগানোর জন্য উৎসাহিত করা,” যোগ করেন তিনি।
প্রযুক্তি এবং উদ্যোক্তা চেতনা
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, প্রযুক্তি শুধুমাত্র ব্যবসার জন্য নয়, বরং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, পরিবহন, তথ্যপ্রযুক্তি এবং যোগাযোগের সকল ক্ষেত্রে উদ্ভাবনের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। তিনি উল্লেখ করেন, “যদি মানুষ প্রযুক্তি ব্যবহার করতে শিখতে পারে, তবে উদ্যোক্তা হওয়া সহজ হবে। প্রযুক্তি আমাদেরকে শুধু দেশেই নয়, বিশ্বের সাথে সংযুক্ত করে দেয়। এই সুযোগকে কাজে লাগানোই মূল চ্যালেঞ্জ।”
বিশেষ করে, তিনি তরুণদের প্রতি আহ্বান জানান, তারা যেন নতুন ধারণা ও প্রযুক্তির মাধ্যমে নতুন ব্যবসা বা উদ্যোগ শুরু করে। “তরুণরা হল দেশের ভবিষ্যৎ। তাদের উদ্ভাবনী চেতনা, সৃজনশীলতা এবং উদ্যোগী মানসিকতা সমাজ ও অর্থনীতির জন্য অপরিসীম অবদান রাখতে পারে,” বলেন অধ্যাপক ইউনূস।
পিকেএসএফ-এর নতুন ভবন: নতুন সূচনা
পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন বা পিকেএসএফ বাংলাদেশের অন্যতম স্বনামধন্য সামাজিক উদ্যোগ। তাদের নতুন ভবন উদ্বোধনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি নতুন মাত্রা যোগ করতে যাচ্ছে। অধ্যাপক ইউনূস আশা প্রকাশ করেন যে, নতুন ভবনটি কেবল একটি শারীরিক স্থান নয়, বরং উদ্যোক্তা এবং নতুন ধারণার জন্য একটি উদ্দীপক কেন্দ্র হবে।
তিনি বলেন, “পিকেএসএফ-এর নতুন ভবন নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করবে। এটি শুধু একটি অফিস নয়, বরং একটি উদ্যোগের স্থান যেখানে মানুষ তাদের সৃজনশীলতা, উদ্যোগী মানসিকতা এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করে নতুন কিছু সৃষ্টি করতে পারবে।”
সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব
উদ্যোক্তাদের সংখ্যা বাড়লে দেশের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “যখন মানুষ নতুন ব্যবসা শুরু করবে, তখন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন হবে এবং দেশ এগিয়ে যাবে। এটি শুধু আর্থিক উন্নয়ন নয়, বরং সামাজিক উন্নয়নেও বিশেষ অবদান রাখে। মানুষকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশের সমগ্র অর্থনীতি ও সমাজে স্থায়ী উন্নয়ন নিশ্চিত করা যায়।”
তরুণ উদ্যোক্তাদের প্রতি বার্তা
উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিকতা তৈরির ক্ষেত্রে তরুণদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “তরুণরা নতুন চিন্তা, নতুন উদ্ভাবন এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসে। তাদেরকে উৎসাহিত করা হলে তারা শুধু নতুন ব্যবসা শুরু করবে না, বরং দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটকেও উন্নত করবে। আমাদের কাজ হল তাদের উপযুক্ত সুযোগ, প্রযুক্তি এবং সমর্থন প্রদান করা।”
উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য মূল দক্ষতা
অধ্যাপক ইউনূস আরও বলেন, উদ্যোক্তা হতে হলে শুধু ব্যবসায়িক দক্ষতা নয়, সৃজনশীলতা, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা, প্রযুক্তি ব্যবহার, নেতৃত্ব গুণাবলী এবং ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতা থাকতে হবে। তিনি বলেন, “যদি মানুষ এই দক্ষতাগুলো অর্জন করে, তবে তারা শুধুমাত্র সফল উদ্যোক্তা হবেন না, বরং সমাজ ও দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হয়ে উঠবেন।”
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা
পিকেএসএফ-এর নতুন ভবনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি নতুন উদ্যোগ শুরু করতে যাচ্ছে। অধ্যাপক ইউনূস আশা প্রকাশ করেন, “আমরা চাই প্রতিটি মানুষ তাদের স্বপ্ন ও সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে উদ্যোক্তা হিসেবে এগিয়ে আসুক। আমাদের কাজ হলো তাদের সেই সুযোগ দেওয়া। নতুন ভবন আমাদের সেই লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করবে।”
তিনি উল্লেখ করেন, দেশের তরুণদের মধ্যে উদ্যোক্তা চেতনা বাড়ানো এবং প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা এখন সময়ের প্রধান চ্যালেঞ্জ। “যদি আমরা এখনই তরুণদের প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনের সঙ্গে যুক্ত করতে পারি, তবে আগামীতে তারা দেশের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে,” বলেন তিনি।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে, মানুষ জন্মেছেন উদ্যোক্তা হতে, চাকরি করার জন্য নয়। প্রযুক্তির মাধ্যমে নতুন সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে এবং পিকেএসএফ-এর নতুন ভবন সেই সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করবে। তরুণরা দেশকে এগিয়ে নিতে নতুন উদ্ভাবন, উদ্যোক্তা চেতনা এবং সৃজনশীলতার মাধ্যমে বিশেষ অবদান রাখতে পারে।
MAH – 12802 Signalbd.com