ব্যাংক

ইসলামী ব্যাংকে চাকরি-ছাঁটাই, নিয়োগ নীতি ও বিতর্ক

Advertisement

বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি বর্তমানে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে। একদিকে ব্যাংকটি অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছাঁটাই শুরু করেছে, অন্যদিকে নতুন জনবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। এই দুই ধরণের পদক্ষেপ ব্যাংক ও সমগ্র অর্থনৈতিক দুনিয়ায় নানা প্রশ্ন ও আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

অবৈধ নিয়োগ ও তার প্রভাব

২০১৭ সালে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ইসলামী ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তাকে ‘অবৈধ প্রক্রিয়া’ দ্বারা নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। পরে নতুন পরিচালনা পর্ষদ এসব নিয়োগের যথার্থতা যাচাই শুরু করে।

ব্যাংকটির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে মোট কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ২২ হাজার, যার মধ্যে ২০১৭ থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত নিয়োগপ্রাপ্তদের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। এই নিয়োগ প্রক্রিয়ার অধিকাংশই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বা মূল্যায়ন পরীক্ষা ছাড়া সম্পন্ন হয়েছিল।

এসব প্রক্রিয়ার ফলে ব্যাংকটি বড় ধরনের আর্থিক ও প্রশাসনিক সংকটে পড়েছে। যেমন, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ডিসেম্বর ২০২৪ শেষে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬৫,৭১৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪২.২২ শতাংশ।

এস আলম গ্রুপের প্রভাব

২০১৭ সালে এস আলম গ্রুপের শীর্ষ কর্মকর্তা সাইফুল আলমের নেতৃত্বে ব্যাংকটি কার্যত দখল করা হয়। এই সময়ে ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের অর্থ বের করে নেওয়া হয়। খবর অনুযায়ী, এস আলম গ্রুপ এবং সমর্থক ব্যবসায়ীরা প্রায় এক লাখ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে তোলা হয়, যা এখনো ফেরত আসেনি।

নিয়োগের ক্ষেত্রেও সরাসরি প্রভাব দেখা যায়। পটিয়া, আনোয়ারা ও বাঁশখালীর মতো উপজেলা ভিত্তিক আলাদা বক্সে জীবনবৃত্তান্ত জমা পড়লেই চাকরি দেওয়া হতো। এছাড়া, এস আলমের গৃহকর্মী, তার স্বামী, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও মন্ত্রীদেরও বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

চাকরির অযোগ্যতা ও যাচাই প্রক্রিয়া

নিয়োগের পরে ব্যাংকটি বিভিন্ন দিক থেকে সমস্যার মুখে পড়েছে। বিশেষ করে, চাকরিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকের সনদ জালিয়াতির অভিযোগ পাওয়া গেছে।

  • বিজিসি ট্রাস্ট এবং পোর্ট সিটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রমাণ যাচাই করতে সহযোগিতা করেনি।
  • ব্যাংকের নতুন পরিচালনা পর্ষদ একাধিক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঋণ, বিনিয়োগ ও জনবল যাচাই করেছে।

এর ফলাফল অনুযায়ী, ৫,৩৮৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগ্যতা যাচাই করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গত শনিবার অনুষ্ঠিত মূল্যায়ন পরীক্ষায় ৪,৯৫৩ জন অংশগ্রহণ করেননি, যাদের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ওএসডি করা হয়েছে। এছাড়া, চাকরিবিধি লঙ্ঘনের কারণে ২০০ জনকে সরাসরি ছাঁটাই করা হয়।

চট্টগ্রামের পটিয়ায় ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদে কর্মীদের বিক্ষোভ হয়, যা পরে পুলিশ দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

নতুন নিয়োগের উদ্যোগ

ছাঁটাইয়ের পাশাপাশি ব্যাংকটি নতুন নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে।

  • পদের নাম: ট্রেইনি অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার (ক্যাশ)
  • যোগ্যতা: স্নাতক বা স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ

ইসলামী ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামাল উদ্দীন জসীম বলেন, “নীতিমালা না মেনে যাঁরা নিয়োগ পেয়েছেন, সবার যোগ্যতা যাচাই করা হবে। ব্যাংকের সেবার মান ধরে রাখতে যোগ্য কর্মকর্তা থাকা জরুরি। এজন্য নতুন জনবল নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে এবং যথাযথ মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রুত নিয়োগ দেওয়া হবে।”

জনবল বৃদ্ধি ও প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ

এস আলমের দখলের আগে ২০১৬ সালের শেষে ব্যাংকের মোট কর্মকর্তা সংখ্যা ১৩,৫৬৯ জন, যার মধ্যে চট্টগ্রামের সংখ্যা ৭৭৬ জন। বর্তমানে ব্যাংকের কর্মকর্তা সংখ্যা প্রায় ২২ হাজার, যার প্রায় ১১ হাজার চট্টগ্রাম বিভাগের কর্মকর্তা

অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে যোগ্য কর্মকর্তাও আছেন, যারা ৬-৭ বছর ধরে ব্যাংকে কাজ করছেন। ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকরা বলছেন, হঠাৎ করে সবকেই বাদ দিলে ব্যাংককে আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষতির মুখে পড়তে হতে পারে। এজন্য সতর্ক পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

অর্থনৈতিক প্রভাব

ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান পরিস্থিতি দেশের বেসরকারি ব্যাংক খাতের জন্য বড় সতর্কবার্তা। অবৈধ নিয়োগ, ঋণের খেলাপি, এবং আর্থিক দুর্নীতি ব্যাংকের সমগ্র কার্যক্রমকে প্রভাবিত করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলি ব্যাংকের ঋণ, বিনিয়োগ এবং জনবল যাচাই করছে। ব্যাংকটি নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করতে এবং নতুন জনবল যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান পদক্ষেপে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে:
১. অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্তদের যাচাই ও ছাঁটাই – ব্যাংকের স্বচ্ছতা ও আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য।
২. নতুন নিয়োগের মাধ্যমে যোগ্য জনবল 확보 – ব্যাংকের সেবা মান বজায় রাখা এবং ভবিষ্যতে আর্থিক ক্ষতি প্রতিরোধের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

এ পরিস্থিতি স্পষ্টভাবে দেখায় যে, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ার যথাযথ নিয়মকানুন মানা না হলে ব্যাংকের সার্বিক কার্যক্রমে বড় প্রভাব পড়তে পারে।

ইসলামী ব্যাংকের এই পদক্ষেপ সমগ্র বেসরকারি ব্যাংক খাতের জন্য একটি শিক্ষণীয় ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছে। নিয়োগে স্বচ্ছতা, নিয়মিত মূল্যায়ন, এবং যোগ্য জনবল নিশ্চিত করাই হবে ভবিষ্যতের স্থিতিশীলতার চাবিকাঠি।

সারসংক্ষেপ:

  • ব্যাংকে অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্তদের ছাঁটাই চলছে
  • মূল্যায়ন পরীক্ষায় অংশ না নেওয়ায় হাজারো কর্মকর্তা ওএসডি বা বিশেষ দায়িত্বে
  • নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে
  • এস আলম গ্রুপের প্রভাব ও ঋণ খেলাপি এখনও সমস্যার মূল
  • ব্যাংকের লক্ষ্য: স্বচ্ছ নিয়োগ, যোগ্য জনবল, আর্থিক স্থিতিশীলতা

MAH – 13103 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button