বাংলাদেশ

ঘুষের অভিযোগে বিআইডব্লিউটিএ’র ২ কর্মকর্তা বরখাস্ত

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) দুই কর্মকর্তাকে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। নৌসংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগের কর্মকর্তারা জ্বালানি তেলের ঠিকাদারি কাজে অনিয়মের মাধ্যমে উৎকোচ লেনদেন করেছেন—এমন গুরুতর অভিযোগের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসার পর নৌপরিবহন খাত জুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে নৌ খাতের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও সাম্প্রতিক এই ঘটনাটি স্বচ্ছতা এবং সুশাসন নিশ্চিত করার বিষয়ে আবারও নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।

ঘটনার বিবরণ

বুধবার (১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫) নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত এক সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, জ্বালানি তেলের ঠিকাদারি কাজে অবৈধ আর্থিক লেনদেন এবং উৎকোচ গ্রহণের প্রমাণের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

সাময়িকভাবে বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তারা হলেন—

  • মো. আব্দুর রহিম, অতিরিক্ত পরিচালক (মেরিন)
  • মো. ওবায়দুল করিম খান, উপপরিচালক

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, এই ঘটনার তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে। পাশাপাশি জড়িত অন্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়।

তদন্ত কমিটির কাজ কী হবে?

তদন্ত কমিটির প্রধান একজন যুগ্মসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা। কমিটির দায়িত্ব হলো—

  • অভিযোগের সত্যতা যাচাই
  • অনিয়মের পেছনে কারা কারা জড়িত, তা খুঁজে বের করা
  • ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের দুর্নীতি আর না ঘটে, সে জন্য সুপারিশ করা

নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অবস্থান

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন:

“সরকার কোনো ধরনের দুর্নীতি বা অনিয়ম বরদাশত করবে না। নৌপরিবহন খাত দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ খাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”

তিনি আরও জানান, প্রমাণিত হলে শুধু বরখাস্ত নয়, অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়াও চালানো হবে।

অতীতে এ ধরনের ঘটনা

বাংলাদেশের নৌপরিবহন খাতে দুর্নীতি নতুন কিছু নয়। বিগত এক দশকে বিভিন্ন সময়ে—

  • ঘাট ইজারা নিয়ে অনিয়ম,
  • ফেরিঘাটে টিকিট কালোবাজারি,
  • নদী দখল,
  • অকারণে ড্রেজিং প্রকল্পে অর্থ আত্মসাৎ,
  • জ্বালানি ও সরঞ্জাম সরবরাহে অতিরিক্ত বিল দেখানো

—এসব অভিযোগ একাধিকবার উঠেছে।

২০১৯ সালে দুর্নীতির অভিযোগে বিআইডব্লিউটিএ’র কয়েকজন কর্মকর্তা শাস্তির মুখোমুখি হয়েছিলেন। তবে বড় কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন ঘটেনি।

কেন ঘুষের ঘটনা বাড়ছে?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি টেন্ডার, বিশেষ করে জ্বালানি তেল, ড্রেজিং বা অবকাঠামো উন্নয়নের মতো প্রকল্পগুলোতে বিশাল অঙ্কের টাকা জড়িত থাকে। সঠিক মনিটরিং না থাকায় এবং কিছু প্রভাবশালী গোষ্ঠীর প্রভাবের কারণে ঘুষ ও দুর্নীতি প্রায় নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক জরিপে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে সেবা খাতের মধ্যে নৌপরিবহন অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত খাত।

দুর্নীতির প্রভাব

নৌপরিবহন খাতে দুর্নীতি শুধু অর্থের ক্ষতি করে না, বরং—

  • নদীপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন ব্যাহত হয়
  • নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ে
  • বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট হয়
  • সাধারণ মানুষ ভোগান্তির শিকার হয়

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রতিটি অনিয়ম শেষ পর্যন্ত সাধারণ জনগণকেই ভোগান্তির মুখে ফেলে।

সরকারের পদক্ষেপ

দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকার ইতোমধ্যে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, যেমন—

  • ই-টেন্ডারিং সিস্টেম চালু: টেন্ডার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনার চেষ্টা
  • অভ্যন্তরীণ অডিট জোরদার: নিয়মিতভাবে কর্মকর্তাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ
  • ডিজিটাল মনিটরিং: জ্বালানি সরবরাহ ও ব্যবহার অনলাইনে মনিটর করার উদ্যোগ
  • দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সম্পৃক্ততা: গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলোতে দুদকের ভূমিকা বাড়ানো

জনগণের প্রত্যাশা

এই ধরনের ঘটনার পর সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা হলো—

  • দ্রুত তদন্ত সম্পন্ন করা
  • দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া
  • নৌপরিবহন খাতে দীর্ঘমেয়াদী সংস্কার করা
  • ঘুষ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়ন

ঢাকার সদরঘাটে এক যাত্রী বলেন:

“প্রতিবার খবর বের হয়, আবার চাপা পড়ে যায়। এবার যদি সত্যি দোষীরা শাস্তি পায়, তবে মানুষ বিশ্বাস ফিরে পাবে।”

বিআইডব্লিউটিএ’র দুই কর্মকর্তা বরখাস্তের ঘটনা বাংলাদেশের নৌপরিবহন খাতে স্বচ্ছতা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। এটি একদিকে সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানের প্রতিফলন, অন্যদিকে খাতটির গভীরে থাকা অনিয়মের জটিল চিত্রও প্রকাশ করছে।

সবার প্রত্যাশা, এই তদন্ত যেন কেবল কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ না থেকে সত্যিকার অর্থে দুর্নীতি দমন ও নৌপরিবহন খাতকে সুশাসনের আওতায় আনতে ভূমিকা রাখে।

MAH – 12756,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Advertisement
Back to top button