বানিজ্য

বিনিয়োগ ও ব্যবসা বাড়াতে গেলে খরচও বেড়ে যাবে

Advertisement

আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বিনিয়োগ এবং ব্যবসা সম্প্রসারণে বাস্তবসম্মত ও সমন্বিত কোনো উদ্যোগ স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়নি। বাজেট বক্তৃতায় ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নয়নের নানা দিক তুলে ধরা হলেও গভীর বিশ্লেষণে বোঝা যায়, নতুন করে বিনিয়োগ বা কারখানা সম্প্রসারণে উদ্যোক্তাদের খরচ বৃদ্ধির আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

বাংলাদেশে আমদানি বিকল্প স্থানীয় শিল্পের বিকাশ গত কয়েক দশকে দৃশ্যমান হয়েছে। বিশেষ করে টয়লেট্রিজ, কসমেটিকস, নির্মাণসামগ্রীসহ বেশ কিছু খাতে দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। কিন্তু এসব খাতের অধিকাংশ কাঁচামাল আমদানিনির্ভর হওয়ায় ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ার কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। গত দু-তিন বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান ৫০ শতাংশের বেশি অবমূল্যায়িত হয়েছে। ফলে আমদানিকৃত কাঁচামালের খরচ একই হারে বেড়ে যাওয়ায় দেশীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো মারাত্মক চাপের মুখে রয়েছে। এই অবস্থায় তাদের জন্য বিশেষ সুরক্ষার প্রয়োজন থাকলেও প্রস্তাবিত বাজেটে তার বাস্তব প্রতিফলন অনুপস্থিত।

শিল্পখাতে সমন্বিত সুরক্ষা নেই

বাজেটে স্থানীয় শিল্পের সুরক্ষায় বিচ্ছিন্নভাবে কিছু সুবিধা ঘোষণা করা হলেও তা কোনোভাবেই সামগ্রিকভাবে স্থানীয় উৎপাদন খাতকে সহায়তা করবে না। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে নীতিগত দ্বৈততা এবং অসামঞ্জস্য লক্ষ্য করা গেছে, যা শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও চাপের মুখে ফেলতে পারে।

উদাহরণ হিসেবে স্যানিটারি ন্যাপকিন শিল্পের কথা বলা যায়। নারীদের প্রয়োজন বিবেচনায় সরকার পরিবেশক পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতির ঘোষণা দিয়েছে, যার প্রভাবে স্যানিটারি ন্যাপকিনের দাম ১-২ শতাংশ কমতে পারে। কিন্তু একই সঙ্গে এ পণ্যের মূল কাঁচামালের আমদানি শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে, যা উৎপাদন ব্যয় ১০ শতাংশ বাড়িয়ে দেবে। এতে উৎপাদনকারীরা কাঁচামাল আমদানিতে বাড়তি খরচের মুখে পড়বে এবং সেই ব্যয় পণ্য মূল্যে প্রতিফলিত হবে। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, একটি খাতে সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি অন্য প্রান্তে চাপ বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, যার ফলে ভ্যাট অব্যাহতির সুফল ভোক্তারা পুরোপুরি পাবে না।

টয়লেট্রিজ ও কসমেটিকস শিল্পের সংকট

বাংলাদেশে টয়লেট্রিজ ও কসমেটিকস খাত গত দুই দশকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রসারিত হয়েছে। এসব খাতে প্রায় ৮০ শতাংশ কাঁচামালই আমদানি করতে হয়। অতীতে আমদানি বিকল্প পণ্য উৎপাদনে সরকার কিছুটা সহায়তা করলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈদেশিক মুদ্রার চাপে এসব শিল্প আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতগুলোকে সুরক্ষিত করতে প্রয়োজন ছিল আমদানি শুল্ক হ্রাস, বিশেষ ঋণ সুবিধা, কিংবা কাঁচামাল আমদানিতে কর রেয়াত। কিন্তু বাজেটে এসব খাতের জন্য তেমন কোনো উদ্দীপক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি, বরং শুল্কবৃদ্ধির মতো কিছু সিদ্ধান্ত তাদের আরও ঝুঁকিতে ফেলবে।

নির্মাণ খাতে খরচ বাড়ার শঙ্কা

বাজেটে নির্মাণসামগ্রী আমদানির ওপর কয়েকটি শুল্ক ও ভ্যাট বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে, যার ফলে নির্মাণ খরচ বাড়বে। উদ্যোক্তারা যখন নতুন কারখানা স্থাপন, পরিকাঠামো সম্প্রসারণ কিংবা নতুন প্রকল্প হাতে নেবেন, তখন এই বাড়তি নির্মাণ ব্যয় তাদের সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে মাঝারি ও ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য এটি একটি নিরুৎসাহব্যঞ্জক বার্তা।

নির্মাণ খাতে বাড়তি খরচ মানেই দেশের অবকাঠামো উন্নয়নের গতি শ্লথ হয়ে যাওয়া। এটি দীর্ঘমেয়াদে দেশের শিল্পায়ন প্রক্রিয়াকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।

বৈদেশিক বিনিয়োগেও নেতিবাচক বার্তা

দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে বাজেটে কোনো স্পষ্ট রূপরেখা দেখা যায়নি। পলিসি ধারাবাহিকতা, কর অবকাঠামো সহজীকরণ, ও লভ্যাংশ দেশে পাঠানোর প্রক্রিয়া সহজ করার মতো গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো উপেক্ষিত রয়ে গেছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয় প্যাকেজ কিংবা নির্দিষ্ট খাতে কর রেয়াতের মতো বিষয়গুলো অনুপস্থিত।

বিনিয়োগ-সহায়ক পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য শুধুমাত্র আইন প্রণয়ন যথেষ্ট নয়, বাস্তবায়নে আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় এবং দীর্ঘমেয়াদি নীতি সহায়তা জরুরি। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে এ ধরনের সমন্বিত কাঠামোর কোনো দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়নি।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য অপ্রতুল সহায়তা

দেশের অর্থনীতির বড় অংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এবারের বাজেটে এই খাতের জন্য সহজ শর্তে ঋণ, করছাড় কিংবা উৎপাদন খরচ হ্রাসের মতো কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। বরং সামগ্রিকভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি হওয়ায় এই শ্রেণির উদ্যোক্তারা আরও সংকটে পড়বে।

সমন্বিত অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব

এবারের বাজেট বিশ্লেষণে দেখা যায়, ব্যবসা ও শিল্পখাতে বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে যেমন পরিবেশ তৈরির কথা বলা হয়েছে, বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন। প্রতিটি খাতে বিচ্ছিন্ন কিছু উদ্যোগ দেখা গেলেও সমন্বিত অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব সুস্পষ্ট। সরকার হয়তো ভ্যাট অব্যাহতি কিংবা কিছু শুল্ক পরিবর্তন করে তাৎক্ষণিক প্রভাব ফেলতে চেয়েছে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এগুলো কতোটা টেকসই বা সহায়ক হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে যায়।

সামগ্রিকভাবে বাজেটটি একটি মিশ্র বার্তা দিচ্ছে। একদিকে কিছু খাতে ভর্তুকি বা করছাড় দেওয়া হলেও অন্যদিকে মূল উৎপাদন উপকরণে শুল্ক বাড়িয়ে তা আবার চাপের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে উদ্যোক্তাদের। এমন দোদুল্যমান নীতি ভবিষ্যতের ব্যবসা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে নিরুৎসাহ সৃষ্টি করতে পারে।

উপসংহার

দেশের শিল্প, ব্যবসা এবং বিনিয়োগখাতে চলমান বৈশ্বিক সংকট ও অভ্যন্তরীণ চাপ বিবেচনায় একটি সাহসী, উদ্দীপনামূলক এবং সমন্বিত বাজেট প্রত্যাশা করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে প্রস্তাবিত বাজেট সে প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। বিশেষ করে বিনিয়োগ ও ব্যবসার সম্প্রসারণে যেসব বাধা তৈরি হতে পারে, সেগুলো দূর করার কোনো সুদৃঢ় উদ্যোগ দেখা যায়নি।

বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধিকে টেকসই করতে হলে শিল্পখাতের সম্প্রসারণ, উদ্যোক্তাদের জন্য সহায়ক নীতি এবং বিনিয়োগ-বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। তা না হলে প্রস্তাবিত বাজেটের মাধ্যমে দেশের উৎপাদন ও শিল্পায়ন প্রক্রিয়া আরও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button