বিশ্ব

পশ্চিমবঙ্গে ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’ মামলায় ৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

Advertisement

পশ্চিমবঙ্গের কল্যাণী মহকুমা আদালত প্রযুক্তি ভিত্তিক প্রতারণার মামলায় নজিরবিহীন রায় দিয়েছেন। ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’ নামে পরিচিত এক নতুন প্রতারণার ধরনকে ধরিয়ে দিয়ে ৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন। ভারতে প্রযুক্তির মাধ্যমে পরিচালিত এমন একটি প্রতারণার জন্য এটাই প্রথমবারের মতো যাবজ্জীবন সাজা।

এই রায় পশ্চিমবঙ্গের আইনশৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। আগামী দিনে সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে বলে মনে করা হচ্ছে।

ঘটনার পটভূমি: কিভাবে শুরু হয়েছিল ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’ প্রতারণা?

২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে রানাঘাটের এক অবসরপ্রাপ্ত কৃষিবিজ্ঞানী ওই প্রতারণার শিকার হন। হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে একটি ফোন আসে, যেখানে মুম্বাই পুলিশের ভুয়া পরিচয়ে তাকে জানান হয় যে, তিনি একাধিক গুরুতর অপরাধে জড়িত। তদন্তের স্বার্থে তাঁকে ডিজিটালি ‘গৃহবন্দী’ থাকতে হবে এবং সাত দিনের মধ্যে বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে এক কোটি টাকা পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়।

ভয়ে ও ভুল তথ্যের ফাঁদে পড়ে তিনি বাধ্য হন ওই বিশাল অঙ্কের টাকা প্রেরণ করতে।

আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে তদন্ত

মামলা দায়েরের পর ২০২৪ সালের ৬ নভেম্বর কল্যাণী সাইবার থানায় অভিযোগ করা হয়। রানাঘাট থানার আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে শুরু হয় তদন্ত। পুলিশ জানতে পারে, পুরো প্রতারণা চক্রটি মূলত কম্বোডিয়া থেকে পরিচালিত হচ্ছিল। অর্থ জমা পড়ত ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে থাকা সহযোগীদের অ্যাকাউন্টে।

এর পর গুজরাট, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান ও হরিয়ানায় একযোগে অভিযান চালিয়ে ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। উদ্ধার করা হয় বহু ATM কার্ড, ব্যাংক পাসবই, এবং গুরুত্বপূর্ণ নথি যা প্রতারণার প্রমাণস্বরূপ কাজ করে।

বিচার প্রক্রিয়া ও রায়

মামলায় ২৬০০ পাতার চার্জশিট দাখিল করা হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে ৯ জনের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত প্রমাণ পাওয়া যায় এবং তাঁদের বিচার শেষ হয়। চার মাস ধরে চলা বিচার প্রক্রিয়ায় ২৯ জন সাক্ষী হাজির হন, যাদের মধ্যে ছ’জন ভিন্ন রাজ্যের বাসিন্দা।

জবাবদিহিতার কঠোর নজির হিসেবে, বিচারক শুভার্থী সরকার ৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন। এই ৯ জন হলেন:

  • মহম্মদ ইমতিয়াজ আনসারি
  • শহিদ আলি শেখ
  • শাহরুখ রফিক শেখ
  • যতীন অনুপ লাডওয়াল
  • রোহিত সিংহ
  • রূপেশ যাদব
  • সাহিল সিংহ
  • পাঠান সুমাইয়া বানু
  • ফালদু অশোক

আইনজীবীদের বক্তব্য ও প্রতারণার বিস্তার

সরকারি আইনজীবী বিভাস চট্টোপাধ্যায় জানান, এই ৯ জনের বিরুদ্ধে রাজ্য ও দেশের বিভিন্ন থানায় মোট ১০৮টি প্রতারণার মামলা রয়েছে। মোট প্রতারণার অর্থের পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি টাকা বলে জানা গেছে।

আইনজীবী মহলের মতে, এই রায় একটি শক্তিশালী বার্তা দিয়েছে সাইবার অপরাধীদের প্রতি। প্রযুক্তির সুযোগ নিয়ে যারা প্রতারণা চালায়, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজনীয়তা আরও স্পষ্ট হয়েছে।

ডিজিটাল অ্যারেস্ট: নতুন এক সাইবার অপরাধের ধারণা

‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’ বলতে বোঝানো হয় এমন এক প্রতারণার পদ্ধতি যেখানে কাউকে ফোন বা অনলাইন মাধ্যমে ভুয়া আইনি প্রক্রিয়া দেখিয়ে ডিজিটালি আটকানোর (গৃহবন্দী রাখার) ভয় দেখানো হয়। এতে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে অর্থ আদায় করা হয়।

ভারতে এই ধরনের অপরাধ নতুন হলেও এর পরিণতি ভয়াবহ। কারণ, প্রযুক্তির অচেনা দিক ব্যবহার করে প্রতারকরা দ্রুত বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি করতে পারে। তাই এ ধরনের মামলার যথাযথ ও দ্রুত বিচার অত্যন্ত জরুরি।

সাইবার নিরাপত্তার গুরুত্ব ও ভবিষ্যত করণীয়

বর্তমান ডিজিটাল যুগে সাইবার নিরাপত্তা এবং প্রযুক্তি সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। সরকার, পুলিশ ও বিচার বিভাগকে একযোগে কাজ করতে হবে যাতে এই ধরনের অপরাধ রোধ করা যায়।

  • নাগরিকদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, বিশেষ করে অনলাইন কল ও মেসেজের মাধ্যমে ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়ের বিষয়ে।
  • সাইবার থানাগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দ্রুত তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে।
  • বিচার প্রক্রিয়া দ্রুততর করে অপরাধীদের কঠোর শাস্তি প্রদান করা দরকার।

অন্যান্য রাজ্যে সাইবার অপরাধের ঝুঁকি ও পর্যালোচনা

পশ্চিমবঙ্গের এই রায় সারা ভারতের জন্য একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে। গুজরাট, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান ও হরিয়ানায় গ্রেপ্তারকৃত প্রতারকরা প্রমাণ করে, প্রতারণা একটি দেশের সীমানায় সীমাবদ্ধ নয়। সাইবার অপরাধের জন্য আন্তঃরাজ্য ও আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট।

বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাইবার অপরাধও ক্রমবর্ধমান। তাই শুধুমাত্র আইন প্রয়োগ নয়, শিক্ষাজাগরণ, সচেতনতা ও প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি গ্রহণ করাও সমান জরুরি।

পশ্চিমবঙ্গে ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’ প্রতারণার ঘটনায় ৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া ঘটনা ভারতীয় বিচারব্যবস্থার জন্য একটি মাইলফলক। এটি প্রযুক্তি নির্ভর সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

নাগরিকদের উচিত প্রযুক্তি সচেতনতা বৃদ্ধি করে অনলাইন নিরাপত্তা বজায় রাখা এবং সন্দেহজনক ফোন, মেসেজ ও অনলাইন কার্যকলাপে সাবধান থাকা। অপরদিকে প্রশাসনকে অবশ্যই প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধের দ্রুত ও সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে।

ভবিষ্যতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে প্রতারণার ঝুঁকি কমাতে সবাইকে সচেতন ও সজাগ থাকা ছাড়া বিকল্প নেই।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button