ঢাকা-উত্তরবঙ্গ যোগাযোগের মূল সড়ক যমুনা সেতু এখনো দেশের গুরুত্বপূর্ণতম সেতু। তবে দীর্ঘদিন যাবৎ সেতুতে যানজটের সমস্যা ছিল চলমান উদ্বেগের বিষয়। এবার যমুনা সেতুর রেললাইন তুলে দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে সড়কের পাশের জায়গা প্রায় সাড়ে ১১ ফুট বেড়ে যাবে। এই বাড়তি জায়গাকে ব্যবহার করে সড়ক সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নিয়েছে সেতু বিভাগ। এর ফলে যানজট কমে যাত্রীরা আরও স্বস্তিতে যাতায়াত করতে পারবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
রেললাইন অপসারণের পেছনের কারণ ও নতুন রেলসেতুর গুরুত্ব
গত ফেব্রুয়ারিতে যমুনা নদীর ওপর দেশের দীর্ঘতম নতুন রেলসেতু চালু হয়েছে। এরপর পুরনো যমুনা সেতুতে রেল চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। রেলপথ মুক্ত হওয়ায় সড়কপথ সম্প্রসারণ সম্ভব হচ্ছে।
নতুন রেলসেতুর দৈর্ঘ্য ৪.৮ কিলোমিটার, যার নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৬,৭৮১ কোটি টাকা। বাংলাদেশ সরকার ও জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগী প্রতিষ্ঠান জাইকার অর্থায়নে এটি নির্মিত।
সড়ক সম্প্রসারণে দেশি প্রকৌশলী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান
সড়ক সম্প্রসারণের জন্য নকশা ও ব্যয় নির্ধারণে দেশে ছয়টি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আগের মতো বিদেশি নয়, এবার দেশি টিম কাজ করছে।
সেতু বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী কাজী মোহাম্মদ ফেরদৌস জানিয়েছেন, বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়ার পরই কাজ শুরু হবে। আশা করা হচ্ছে ছয় মাসের মধ্যে কাজের ধারা শুরু হবে।
যমুনা সেতুর বর্তমান সড়ক সমস্যা
১৯৯৮ সালে যমুনা নদীর ওপর সেতুটি চালু হলেও তখন রেললাইন ছিল না। পরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সেতুর এক পাশে রেললাইন বসানো হয়। এতে সড়কের চওড়া সংকুচিত হয়ে যানজট তৈরি হয়।
বর্তমানে যমুনা সেতুর যান চলাচলের পথ প্রায় ৪১ ফুট চওড়া। এর মধ্যে রেললাইন উঠানো হলে প্রায় সাড়ে ১১ ফুট বাড়বে। এতে দুই দিকের যান চলাচলের পথ আরও প্রশস্ত হয়ে পৌনে ছয় ফুট করে বাড়ানো সম্ভব হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী চার লেনের সড়কের প্রতিটি দিকের প্রস্থ কমপক্ষে ২৪ ফুট হওয়া প্রয়োজন। যমুনা সেতুতে এ মান পূরণ হয়নি। ফলে সেতুতে যানবাহন চলাচল কঠিন ও ধীরগতিতে হয়।
যানজটের বাস্তব চিত্র
সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনগুলো ছাড়াও ঈদ, পহেলা বৈশাখ, দুর্গাপূজা, শীতকালীন ছুটিসহ নানা উৎসবে সেতুর দুই পাশে লম্বা যানজট হয়। গত ঈদুল আজহার সময় একদিনে ৬৪ হাজারের বেশি যানবাহন সেতু পারাপার হয়েছে।
যমুনা সেতুর পূর্ব-পশ্চিম প্রান্তে যে চার লেনের মহাসড়ক রয়েছে, সেগুলোর পাশের প্রস্থ ২৪ ফুটের বেশি। অথচ সেতুর পথ সংকীর্ণ হওয়ায় যানবাহন সেতুতে ঢোকার সময় থেমে যায়, ফলে পুরো মহাসড়কের গতি বন্ধ হয়ে যায়।
রেললাইন অপসারণ ও কাজের অগ্রগতি
গত জুন মাসে সিরাজগঞ্জ থেকে যমুনা সেতুর রেললাইন তুলে ফেলার কাজ শুরু হয়েছে। নাট-বল্টু খুলে কাজ এগুচ্ছে। রেলওয়ে সূত্র বলছে, আগামী তিন মাসের মধ্যে রেললাইন অপসারণ সম্পন্ন হবে।
গত মাসে সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী শেখ মইনউদ্দিনের নেতৃত্বে কাজ পরিদর্শন করেন। তিনি দ্রুত রেললাইন সরানোর নির্দেশ দেন।
অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা
যমুনা সেতুর রেললাইন যুক্ত করার সিদ্ধান্ত ২০০০ দশকের শুরুর দিকে নেওয়া হলেও সেতু নির্মাণের সময় এর জন্য আলাদা পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেললাইন যুক্ত করার নির্দেশ দিলে নকশা পরিবর্তন করা হয়।
এর ফলে সেতুর চার লেনের রাস্তাটি সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। রেললাইন সরানোর কাজ আগে করা হয়নি কারণ তখনকার সরকার এতে আগ্রহী ছিলেন না।
সরকারের বর্তমান মনোভাব ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সেতু বিভাগ আবার এই প্রস্তাব দিলে তা অনুমোদন হয়। পরামর্শক নিয়োগ দিয়ে নকশা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা শেখ মইনউদ্দিন জানিয়েছেন, রেললাইন উঠে গেলে সেতুর সড়ক পথে আরও চওড়া পথ তৈরি হবে। এতে যাত্রী ও যানবাহনের যাত্রা সহজ হবে, যানজট কমে যাবে।
সেতুর চওড়া বৃদ্ধি: আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সঙ্গতি
পদ্মা সেতু ও দেশের অন্যান্য নতুন সেতুর তুলনায় যমুনা সেতুর সড়ক পথ সংকীর্ণ। পদ্মা সেতুতে আসা-যাওয়ার পথে ৩১ ফুট চওড়া পথ রয়েছে। সেখানে রক্ষণাবেক্ষণ কাজেও জায়গা থাকা সত্ত্বেও যমুনা সেতুতে হাঁটার জায়গাও নেই।
সেতু বিভাগ জানায়, দেশের গুরুত্বপূর্ণ সেতুগুলোতে মধ্যবর্তী বিভাজকসহ সড়ক পথ ২৬ ফুট বা তার বেশি চওড়া। যমুনা সেতুর সড়ক পথে এরকম ব্যবস্থা থাকায় সড়ক সম্প্রসারণ জরুরি।
যাত্রীরা অপেক্ষায়: সড়ক সম্প্রসারণে স্বস্তির বার্তা
যমুনা সেতুর দুই প্রান্তের মহাসড়ক সম্প্রসারণের সঙ্গে সেতুর রাস্তা চওড়া হলে যানজট কমবে। বিশেষত ঈদ ও উৎসবকালীন সময়ে যাত্রীরা স্বস্তিতে যাতায়াত করতে পারবেন।
শেখ মইনউদ্দিন বলেন, “এখন যমুনা সেতু দিয়ে গড়ে ২২ হাজার যানবাহন চলাচল করে। রেললাইন সরানোর ফলে আরও বেশি যানবাহন চলাচলের সুযোগ হবে।”
যমুনা সেতুর রেললাইন সরানো এবং সড়কপথ সম্প্রসারণের উদ্যোগ দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন গতি আনবে। দীর্ঘদিনের যানজট সমস্যার সমাধান হয়ে জনগণ সুবিধা পাবে। সেতু বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত কাজ শেষ করতে উদ্যোগী, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ সুগম করবে।
MAH – 12268 , Signalbd.com



