বাংলাদেশ

যাত্রাবাড়ীতে সাংবাদিক হাসান মেহেদীর নির্মম হত্যাকাণ্ড

Advertisement

ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে ১৮ জুলাই, ২০২৪ সালের একদিনে ঘটে যাওয়া এক মর্মান্তিক ঘটনায় প্রাণ হারান তরুণ সাংবাদিক হাসান মেহেদী। তিনি ছিলেন ‘ঢাকা টাইমস’ এর সিনিয়র রিপোর্টার। তখন সারাদেশে ছাত্র-জনতার একটি বৃহৎ আন্দোলন চলছে, সেই আন্দোলনের সঠিক সংবাদ পরিবেশনের জন্য মাঠে নামেন হাসান। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার পথে পুলিশের গুলিতে নিহত হন তিনি, পরিচয়পত্র দেখিয়েও থামানো যায়নি গুলিবর্ষণ।

৩২ বছর বয়সী হাসান মেহেদী পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার ধুলিয়া ইউনিয়নের হোসনাবাদ গ্রামের সন্তান। কর্মসূত্রে ঢাকার কেরানীগঞ্জ এলাকায় স্ত্রী ফারহানা ইসলাম পপি ও দুই কন্যাসন্তানসহ বসবাস করতেন। সহকর্মীরা তাকে আদর্শ, নিষ্ঠাবান ও দায়িত্বশীল সাংবাদিক হিসেবে জানতেন।

হত্যাকাণ্ডের বিবরণ

২০২৪ সালের ১৮ জুলাই বিকেল সাড়ে ৪টার সময় যাত্রাবাড়ী উড়ালসেতু এলাকায় পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতা আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ শুরু হয়। ওই সময় পুলিশি সাঁজোয়া যান থেকে বুলেট ছোড়া হয়। সেসব গুলির মধ্যে পরপর কয়েকটি গুলি এসে আঘাত করে হাসান মেহেদীর ওপর। তিনি ছিলেন একটি চেনার মত পরিচয়পত্র গলায় ঝুলিয়ে রাখছিলেন। বারবার পরিচয়পত্র দেখানোর চেষ্টা করলেও পুলিশ গুলিবর্ষণ থামায়নি।

শরীরে শতাধিক ছররা গুলি লাগার পর হাসান ঘটনাস্থলেই লুটিয়ে পড়েন। সহকর্মী ও ছাত্রসমাজ দ্রুত তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।

এই নির্মম হত্যাকাণ্ড পুরো সাংবাদিক সমাজকে দিশাহীন করে দেয়। দেশের স্বাধীন সংবাদমাধ্যমে কাজ করা সাংবাদিকরা তীব্র প্রতিবাদ জানান। সাধারণ নাগরিকরাও নিন্দা ও শোক প্রকাশ করেন।

হত্যার পর মামলা এবং আইনি জটিলতা

হাসান মেহেদীর মৃত্যুর প্রায় এক সপ্তাহ পর, ২৭ জুলাই ২০২৪ পুলিশের পক্ষ থেকে একটি মামলা করা হয়। তবে মামলায় সরাসরি অভিযুক্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয় বিএনপি ও জামায়াত সংশ্লিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তিকে। পরে একটি ‘ফুফু’ পরিচয়প্রাপ্ত নারী ভিন্ন একটি মামলা দায়ের করেন, যা পরে সাংবাদিক ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিভ্রান্তিকর ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে আখ্যায়িত করে।

আইনের নিকটে ন্যায়ের প্রত্যাশা

মৃত্যুর পর থেকে নানা প্রকার চাপ ও রুদ্ধদ্বার পরিবেশ সত্ত্বেও, সাংবাদিক সমাজ ও মানুষের চাপেই আদালতে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে আসল দোষীদের শাস্তি ও সত্য উদঘাটন আজও বহুল প্রত্যাশিত।

সাংবাদিকতা ও মানবাধিকার নিয়ে সচেতনতার বার্তা

এই হত্যাকাণ্ড আমাদের দেশে সাংবাদিকতা ও মানবাধিকার পরিস্থিতির সংকটের একটি দৃষ্টান্ত। সংবাদ সংগ্রহের পথে একজন নির্দোষ সাংবাদিককে হত্যা করাই শুধু নয়, তার পরিচয়পত্র দেখিয়েও গুলিবর্ষণ চালানো—এরকম ঘটনা সমাজে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য গভীর প্রশ্ন তোলে।

সাংবাদিকরা যেভাবে নির্ভয়ে কাজ করতে পারে, সেই পরিবেশ তৈরি করাই এখন সময়ের দাবি। দেশের উন্নয়ন ও সঠিক সংবাদ পরিবেশনের জন্য সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অপরিহার্য।

হাসান মেহেদীর স্মরণে

হাসান মেহেদী একজন নিষ্ঠাবান ও দায়িত্বশীল সাংবাদিক ছিলেন, যিনি সংবাদ পরিবেশনের জন্য জীবন উৎসর্গ করলেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন ও মানবাধিকার সংগঠন প্রতিবছর নানা কর্মসূচি পালন করে।

তার পরিবার আজও ন্যায়ের অপেক্ষায় দিন কাটায়। স্ত্রী ও দুই মেয়ে তাঁর হারানোর শোক সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলেছে।

সমগ্র দেশের জন্য শিক্ষণীয় একটি ঘটনা

এই হত্যাকাণ্ড আমাদের সমাজকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সাংবাদিকতার স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের জন্য অবিচল থাকতে হবে। যে কোনো ধরনের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় সাংবাদিকদের ভূমিকা অপরিসীম।

আমরা আশা করি ভবিষ্যতে সাংবাদিকরা নিরাপদে কাজ করতে পারবেন, এবং এমন নির্মম ঘটনাগুলো আর ঘটবে না।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button