রাজনৈতিক ঐকমত্যে সংশয়: মৌলিক সংস্কার ও দলগুলোর অবস্থান

দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক সংস্কার এবং সংবিধান সংশোধন নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনা এখন পর্যন্ত কোনো চূড়ান্ত ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। সংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবে দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং দ্বিমত স্পষ্ট হওয়ায় আগামী ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় মন্দাবস্থা: ঐকমত্যের পথ কঠিন
রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে গতকাল রোববার অনুষ্ঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফার সপ্তম দিনের আলোচনায় সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, “আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম আবু সাঈদের শাহাদাতবার্ষিকীতে (১৬ জুলাই) সবাই মিলে ‘জুলাই সনদে’ স্বাক্ষর করব। কিন্তু এখন দেখছি, সেটা কতটা সম্ভব হবে তা রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নির্ভর করছে। শঙ্কাও তৈরি হয়েছে।”
এই আলোচনার মূল লক্ষ্য হলো সংবিধান ও নির্বাচনী ব্যবস্থার মৌলিক সংস্কার, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, বিরোধী দলের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ব্যবস্থা, সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়া এবং নিয়োগ কমিটি গঠন। তবে এখন পর্যন্ত মাত্র দুইটি বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে এসেছে।
আলোচনার প্রধান প্রতিবন্ধকতা: মৌলিক সংস্কার নিয়ে দ্বিমত
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, ২০টির মতো মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে আসা হলেও মাত্র ৯টি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন ও বিরোধী দলের সংসদীয় কমিটির সভাপতি হওয়া নিয়ে অংশীদাররা একমত হয়েছেন। অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রীর সর্বোচ্চ মেয়াদকাল নির্ধারণে মোটামুটি সম্মতি আছে, তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট; তারা এনসিসি বা এরকম কোনো নিয়োগ কমিটি গঠনের বিরোধিতা করছে। তারা উল্লেখ করেছে, যদি এই শর্ত মেনে নেয়, তবে প্রধানমন্ত্রী মেয়াদকালের বিষয়ে রাজি হবে। এই ধরনের দ্বিমত ছাড়া সংবিধানিক নিয়োগ প্রক্রিয়া, উচ্চকক্ষ গঠন ও নির্বাচনী এলাকা সীমানা নির্ধারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখনো আলোচনার বাইরে রয়েছে।
এনসিপি ও জামায়াতসহ অন্য দলের শঙ্কা
জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেন জানান, মৌলিক সংস্কারে দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য তৈরি হওয়া কঠিন। তিনি বলেন, “বিএনপি এবং কয়েকটি দলের সঙ্গে দ্বিমত থাকায় বেশির ভাগ প্রস্তাব এখনো ঝুলে আছে। দীর্ঘ আলোচনার পরও তা সমাধান হয়নি।”
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, “নিয়োগ কমিটি নিয়ে পূর্বেও আলোচনা হয়েছে, কিন্তু একসঙ্গে ঐকমত্য হওয়া প্রায় অসম্ভব।” তিনি বিএনপির মতামতকেও উল্লেখ করেন, যারা এ প্রস্তাবের স্পষ্ট বিরোধিতা করছে।
বিএনপির অবস্থান এবং সালাহউদ্দিনের প্রশ্ন
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “যদি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সব প্রস্তাবে শতভাগ একমত হওয়া বাধ্যতামূলক হয়, তাহলে আলোচনার অর্থ থাকে না। আলোচনার জন্য তো আমরা বসছি, যাতে ভিন্নমত প্রকাশ করা যায়।”
তিনি আরও বলেন, “যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে, সেগুলো নিয়ে ‘জাতীয় সনদ’ সই করা হবে। সুতরাং ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া স্পষ্ট করতে হবে।”
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ও নিয়োগ কমিটি: দ্বিধাগ্রস্ত দলসমূহ
আলোচনায় নতুন প্রস্তাব এসেছে সাংবিধানিক নিয়োগ কমিটির বিকল্প হিসেবে ‘সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ কমিটি’ গঠন। বেশিরভাগ দল নীতিগতভাবে এতে সম্মত হলেও বিএনপি ও কিছু দল এখনও দ্বিধাগ্রস্ত।
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন নিয়ে অধিকাংশ দল একমত হলেও উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন পদ্ধতি নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। জামায়াত ও এনসিপি সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির পক্ষপাতী, কিন্তু বিএনপি এ পদ্ধতির বিরোধিতা করছে এবং নিম্নকক্ষে প্রাপ্ত আসনের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষে আসন বণ্টনের পক্ষে।
নাগরিক ঐক্য ও ইসলামী আন্দোলনের দৃষ্টিভঙ্গি
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, “যদি উচ্চকক্ষও নিম্নকক্ষের অনুকরণ হয়, তাহলে তার অস্তিত্বের প্রশ্ন উঠবে।”
অন্যদিকে, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন জানিয়েছেন, “সংসদের নিম্নকক্ষই মূল এবং সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।”
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
আলোচনার শেষে আলী রীয়াজ জানান, এনসিসির পরিবর্তে নিয়োগ কমিটির প্রস্তাবকে বেশিরভাগ দল স্বাগত জানিয়েছে। কিছু সংশোধনের পর ঐ দলগুলোর পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করা হয়েছে। আগামী ২ জুলাই পরবর্তী আলোচনার পরিকল্পনা রয়েছে, যেখানে আশা করা হচ্ছে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর সমাধান আসবে।
তিনি বলেন, “জুলাইয়ের মধ্যে আমরা আলোচনা শেষ করে ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা করতে চাই, যা দেশের গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক সংস্কারের জন্য মাইলফলক হবে।”
পটভূমি: সংবিধান, নির্বাচন ও বিচার বিভাগে সংস্কার
গত বছরের অক্টোবরে অন্তর্বর্তী সরকার ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছিল, যা ফেব্রুয়ারি মাসে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রদান করে। এরপর জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ওই ১৬৬টি সুপারিশ নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করে।
দলগুলোকে ছক আকারে মতগ্রহণ ও আলাদা আলাদা পর্বে আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চলছে। তবে রাজনৈতিক মতবিরোধ এবং স্বার্থের সংঘর্ষ প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারণে সংবিধান ও নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যমত্যের অভাব এই সংস্কারের প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলেছে। আগামী কয়েক সপ্তাহে দলগুলোর সম্মিলিত মনোযোগ ও যৌথ প্রচেষ্টা ছাড়া ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা ও মৌলিক সংস্কার কার্যকর হওয়া কঠিন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।