ঈদের ১৫ দিনে ৩৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৩৯০

এবারের ঈদুল আজহায় দেশে সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহতা যেন বাড়ছেই। মাত্র ১৫ দিনে সারা দেশে ৩৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ৩৯০ জন প্রাণ হারিয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ১ হাজার ১৮২ জন। এই তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেল।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে গত সোমবার (১৬ জুন) অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী এই তথ্য তুলে ধরেন। তিনি জানান, ঈদ যাত্রা শুরু হয় ৩১ মে থেকে এবং কর্মস্থলে ফিরে আসা শেষ হয় ১৪ জুন পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার পাশাপাশি রেল ও নৌপথেও ঘটে বিপুল দুর্ঘটনা।
সড়ক, রেল ও নৌপথে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির বিস্তারিত
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৩৯০ জন, আহত ১১৮২ জন। রেলপথে ২৫টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ২৫ জন, আহত হয়েছে ১২ জন। নৌপথে ১১টি দুর্ঘটনায় ১২ জন নিহত এবং ৬ জন নিখোঁজ রয়েছে। সব মিলিয়ে সড়ক, রেল ও নৌপথ মিলিয়ে মোট ৪১৫টি দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪২৭ জন এবং আহত হয়েছে ১ হাজার ১৯৪ জন।
গত বছরের তুলনায় দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বেড়েছে
২০২৪ সালের ঈদুল আজহার সময় ৩০৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৩৬ জন নিহত ও ৭৬২ জন আহত হয়েছিল। তবে এবার সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ২২.৬৫ শতাংশ, প্রাণহানি বেড়েছে ১৬.০৭ শতাংশ এবং আহতের সংখ্যা বেড়েছে ৫৫.১১ শতাংশ। যা খুবই উদ্বেগজনক।
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা সর্বাধিক
দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণে দেখা গেছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা শীর্ষে রয়েছে। এবারের ঈদে মোট ১৩৪টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৪৭ জন নিহত ও ১৪৮ জন আহত হয়েছে। মোট সড়ক দুর্ঘটনার প্রায় ৩৫.৩৫ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা।
দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতদের মধ্যে ৬১ জন চালক, ৫০ জন পরিবহন শ্রমিক, ৫৮ জন পথচারী, ৪০ জন নারী, ৩০ জন শিশু, ৩২ জন শিক্ষার্থী, ৭ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ৫ জন শিক্ষক, একজন চিকিৎসক, একজন প্রকৌশলী এবং ৮ জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী রয়েছেন।
দুর্ঘটনায় ব্যবহৃত যানবাহনের ধরন
- মোটরসাইকেল: ২৬.৫৪%
- ট্রাক-কাভার্ডভ্যান: ১৯.১১%
- বাস: ১৮.৫৮%
- ব্যাটারিচালিত রিকশা: ১৩.৬২%
- কার-মাইক্রো: ৭.৪৩%
- নছিমন-করিমন: ৭.৬১%
- সিএনজিচালিত অটোরিকশা: ৭.০৭%
দুর্ঘটনার স্থান ও ধরণ
জাতীয় মহাসড়কে দুর্ঘটনার সংখ্যা ৩৭.২০ শতাংশ, আঞ্চলিক মহাসড়কে ২৮.২৩ শতাংশ এবং ফিডার রোডে ২৮.৪৯ শতাংশ। ঢাকা মহানগরীতে ৪.৪৮ শতাংশ, চট্টগ্রাম মহানগরীতে ০.৭৯ শতাংশ এবং রেলক্রসিংয়ে ০.৭৯ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে।
বিস্তারিত বিশ্লেষণ ও কারণসমূহ
ঈদুল আজহার সময় দেশে মানুষ যাতায়াতের জন্য সড়কে ও অন্যান্য পথে বেড়ে যায় যাত্রী ও যানবাহনের চাপ। এই চাপের কারণে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়ে যাওয়াটা একটি সাধারণ প্রবণতা। তবে এবারের সংখ্যা গত বছরের তুলনায় আশংকাজনক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়ে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জোরালো হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানো, ট্রাফিক নিয়ম না মানা, যানবাহনের অপর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণ এবং ড্রাইভারদের অভিজ্ঞতার অভাব। পাশাপাশি অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন, মোবাইল ফোন ব্যবহার করে গাড়ি চালানো, মাদকাসক্তি ও অবহেলা থেকেও দুর্ঘটনা ঘটে।
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন—
- সচেতনতা বৃদ্ধি
- কঠোর আইন প্রয়োগ
- গুণগত মানসম্পন্ন যানবাহন ব্যবহার
- সড়কের অবস্থা উন্নয়ন
- চালকদের প্রশিক্ষণ এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষা
সার্বিক প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া
এই দুর্ঘটনাগুলো শুধু ব্যক্তি ও পরিবারগুলোর জন্য নয়, পুরো জাতির জন্য দুঃখজনক ঘটনা। পরিবারে আশার আলো নিভে যায়, অনেকে প্রতিবন্ধী হয়, আর দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতিও সহ্য করতে হয়। দেশের অর্থনীতির বড় অংশ জড়িত সড়ক পরিবহন খাতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
যাত্রী কল্যাণ সমিতি ও অন্যান্য মানবাধিকার সংগঠন দুর্ঘটনা কমানোর লক্ষ্যে সরকারের কাছে সড়ক নিরাপত্তা পরিকল্পনা আরও শক্তিশালী করার আহ্বান জানিয়েছে।
সমাধানের দিকনির্দেশনা
- সড়ক নিরাপত্তা আইন জোরদার করা
- রেল ও নৌপথে নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত করা
- পরিবহন শ্রমিকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান
- যানবাহন পর্যাপ্ত মেরামত ও পরীক্ষা নিরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা
- জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও দুর্ঘটনা প্রতিরোধ কর্মসূচি চালানো
- আকস্মিক দুর্ঘটনায় দ্রুত উদ্ধার ও চিকিৎসা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা
ঈদুল আজহার সময়ের এই ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে, সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই দেশের উন্নয়নের অন্যতম মূলমন্ত্র। দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেতে জনসাধারণের সচেতনতা এবং সরকারি উদ্যোগ একসাথে কাজ করলে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা সম্ভব।
সতর্কতা, সচেতনতা ও শৃঙ্খলা বজায় রেখে আমরা সবাই মিলে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে পারি। দেশের প্রতিটি মানুষ যেন নিরাপদে তার গন্তব্যে পৌঁছায়, এটাই আমাদের সবার কামনা।