জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়ের চুক্তি বাতিল না করলে কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি হেফাজতের
ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অফিস স্থাপনের চুক্তিকে ‘গোপন ও একতরফা’ সিদ্ধান্ত আখ্যা দিয়ে এর তীব্র বিরোধিতা করেছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। সংগঠনটি জানিয়েছে, চুক্তি বাতিল না হলে তারা কঠোর কর্মসূচি নিতে বাধ্য হবে।
হেফাজতের হুঁশিয়ারি
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অফিস স্থাপনের চুক্তিকে তারা দেশবিরোধী ও ইসলামী মূল্যবোধবিরোধী হিসেবে দেখছে। সংগঠনের আমির আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ও মহাসচিব আল্লামা সাজেদুর রহমান বলেন, “এই সিদ্ধান্ত দেশের ওলামায়ে কেরাম ও সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মতামত উপেক্ষা করে নেওয়া হয়েছে। অবিলম্বে চুক্তি বাতিল না হলে আমরা কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করতে বাধ্য হবো।”
তারা আরও বলেন, “জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস সাধারণত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতে স্থাপন করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ এমন কোনো দেশে পরিণত হয়নি যে এখানে এর প্রয়োজন আছে। বরং এটি একটি রহস্যজনক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সিদ্ধান্ত।”
চুক্তির পটভূমি ও সরকারী অবস্থান
সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনের (OHCHR) একটি কার্যালয় স্থাপনের জন্য সমঝোতা স্মারক (MoU) সই করা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে এই চুক্তিকে মানবাধিকার উন্নয়নের অংশ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হলেও এর বিরোধিতা উঠে এসেছে ইসলামী দলগুলোর পক্ষ থেকে।
হেফাজত বলছে, এই চুক্তির ব্যাপারে জনগণের মতামত নেওয়া হয়নি এবং এটি একটি একতরফা সিদ্ধান্ত। তারা দাবি করছে, এভাবে কোনো স্পর্শকাতর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় নীতির পরিপন্থী।
ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ নিয়ে উদ্বেগ
বিবৃতিতে হেফাজত নেতারা বলেন, “গত এক দশকে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি এনজিও ও সংস্থা বাংলাদেশের মুসলিম পারিবারিক আইন ও ইসলামী শরিয়ার ওপর হস্তক্ষেপের চেষ্টা চালিয়েছে। নারী সংস্কার কমিশনের রিপোর্টেও ধর্মীয় মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে।”
তারা আরও বলেন, “জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের নীতিমালায় সমকামিতা (LGBT) ও লিঙ্গ বৈচিত্র্যকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, যা বাংলাদেশের ধর্মীয়-সামাজিক কাঠামোর পরিপন্থী। সম্প্রতি এমন একজন সমকামী ব্যক্তিকে জাতিসংঘের দূত হিসেবে বাংলাদেশে নিযুক্ত করা হয়েছে, যেটি আমাদের মূল্যবোধের উপর সরাসরি আঘাত।”
পার্বত্য চট্টগ্রাম ও জাতীয় নিরাপত্তা
হেফাজতের বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল ঘিরে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র আরও বিস্তৃত হচ্ছে। তাদের ভাষায়, “জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিসের উপস্থিতি সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হতে পারে। এটি দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে।”
তারা বলছে, জাতিসংঘের এই অফিসের মাধ্যমে দেশের নিরাপত্তা ও ধর্মীয়-সামাজিক কাঠামো দুর্বল করার চেষ্টা চালানো হতে পারে। এই উদ্বেগ থেকে তারা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে চুক্তি বাতিলের।
পুরোনো অভিজ্ঞতা ও জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
হেফাজতের নেতারা অভিযোগ করেছেন, অতীতে বাংলাদেশে আলেম-ওলামার ওপর রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের ঘটনায় জাতিসংঘ কোনো কার্যকর ভূমিকা নেয়নি। তারা উল্লেখ করেন, “২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে আলেম-ওলামার ওপর পরিচালিত নির্যাতনের ঘটনায় জাতিসংঘ কোনো বিবৃতি দেয়নি। অথচ সেই সময় দেশে মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়েছিল।”
তাদের দাবি, “ফিলিস্তিনে গত ৩০ বছর ধরে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অফিস থাকলেও সেখানকার নির্যাতন থামেনি। তাহলে বাংলাদেশে এই অফিস বসিয়ে কী লাভ হবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।”
‘জুলাই বিপ্লব’ বাস্তবায়নের দাবি
হেফাজত নেতারা আরও বলেছেন, সরকার যদি ‘জুলাই বিপ্লব’ দাবিগুলোর বাস্তবায়নে আন্তরিক হতো, তাহলে এই ধরনের বিদেশি হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হতো না। তারা মনে করছেন, এই দাবিগুলো পূরণ করলেই দেশের মধ্যে মানবাধিকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতো।
পরবর্তী পদক্ষেপ কী?
হেফাজতের অবস্থান স্পষ্ট—চুক্তি বাতিল না হলে তারা মাঠে নামবে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে হেফাজতের বক্তব্যের কোনো জবাব দেওয়া হয়নি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই ইস্যু সামনের দিনে আরও উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে।
তবে প্রশ্ন রয়ে যায়—সরকার কি জনগণের ও ইসলামি দলের দাবিকে গুরুত্ব দিয়ে এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবে, নাকি পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত দিকে গড়াবে?
এম আর এম – ০৪১৭, Signalbd.com



