অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, সেনাবাহিনীর অভিযানে ফেরত পেলেন যাত্রীরা

অভিযান যাত্রীর স্বস্তি এনে দিল সেনাবাহিনী
ঈদের আগে-পরে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় যেন সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের অন্যতম উৎস হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিবছর উৎসবের সময় ঘরে ফেরা মানুষের কাছ থেকে বাস কোম্পানিগুলো অনৈতিকভাবে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে। এবার সেই চিত্র দেখা গেল পিরোজপুর জেলার নেছারাবাদে, তবে এবার কিছুটা ভিন্নভাবে। কারণ, এই অনিয়মের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী সরাসরি অভিযান চালিয়েছে।
১৩ জুন ২০২৫, শুক্রবার বিকেলে সেনাবাহিনীর একটি দল নেছারাবাদের বিভিন্ন বাস কাউন্টারে অভিযান চালায়। অভিযানে ঢাকাগামী বাসগুলোর অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, নির্ধারিত সময়ে বাস না ছাড়ার অভিযোগ আমলে নিয়ে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেয় সেনা সদস্যরা।
বাস না আসা, অতিরিক্ত ভাড়া—যাত্রীদের হতাশা
ঈদের পর কর্মস্থলে ফেরা মানুষদের ভোগান্তি যেন থেমে নেই। অনেক যাত্রী আগেভাগেই টিকিট কেটেছিলেন ঠিক সময়ে বাসে উঠবেন বলে। কিন্তু বাস্তবে তাঁরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও বাসের দেখা পাননি।
ঢাকাগামী যাত্রী কাউসার মাহমুদ জানান,
“আমি স্টার ডিলাক্স কাউন্টার থেকে ৮০০ টাকায় টিকিট কাটি। বিকেলে বাস ছাড়ার কথা থাকলেও সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো বাস আসে না। পরে সেনাবাহিনী আসে, তখন কাউন্টার মালিক পালিয়ে যায়। পরে আমরা টাকা ফেরত পাই।”
একই কাউন্টার থেকে টিকিট কাটা আরেক যাত্রী মো. হাসান বলেন,
“পাঁচটার টিকিট কেটেছিলাম, কিন্তু বাস এল না। সেনাবাহিনীর কারণে টাকাটা ফেরত পেয়েছি।”
উজ্জ্বল সাহা নামের এক যাত্রী বলেন,
“আমি যমুনা লাইন থেকে ১ হাজার টাকা দিয়ে ঢাকাগামী টিকিট কেটেছিলাম। পরে অতিরিক্ত ২০০ টাকা ফেরত পেয়েছি।”
সেনাবাহিনীর অভিযান: ব্যবস্থা এবং ফলাফল
উপজেলা সেনা ক্যাম্পের একটি দল বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নেছারাবাদের বাস টার্মিনাল ও বিভিন্ন কাউন্টারে সরেজমিনে অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে প্রমাণ পাওয়ার পর কাউন্টারগুলোকে অতিরিক্ত ভাড়া ফেরত দিতে বাধ্য করা হয়।
অনেক মালিক বা ব্যবস্থাপক অভিযানের সময় কাউন্টার ছেড়ে পালিয়ে যায়। তবে স্থানীয় সেনা কমান্ডারদের নির্দেশে বাকি কর্মচারীদের মাধ্যমে টিকিটধারী যাত্রীদের অর্থ ফেরত দেওয়া হয়।
বাস মালিকদের যুক্তি: ‘ভাড়া কিছুটা বাড়ানো হয়েছে’
বাস কাউন্টার মালিকদের অনেকে জানিয়েছেন,
“ঈদের সময় যাত্রী চাপ অনেক বেশি। ঢাকায় গিয়ে বাসগুলো প্রায় খালি ফিরে আসে। সেই খরচ মেটাতেই সামান্য বাড়তি ভাড়া নেওয়া হয়।”
তবে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা স্পষ্ট করে জানান,
“আইনের বাইরে কোনো ব্যবসা বা সেবা পরিচালনা করা যাবে না। অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া অবৈধ। ঈদের সময় মানুষ অনেক কষ্ট করে টিকিট কাটে—এ সুযোগে তাদের জিম্মি করা গ্রহণযোগ্য নয়।”
স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া: প্রশংসা ও প্রত্যাশা
নেছারাবাদের স্থানীয় বাসিন্দা ও যাত্রীদের মধ্যে সেনাবাহিনীর এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানানো হয়েছে।
সাবেক শিক্ষক রমেশ মল্লিক বলেন,
“প্রশাসনের নজরদারি না থাকলে পরিবহন খাতে নৈরাজ্য চলতেই থাকবে। সেনাবাহিনী যে সাহসিকতা ও দ্রুততা দেখিয়েছে, তা সাধারণ মানুষের জন্য বড় স্বস্তির।”
একজন শিক্ষার্থী আবির হোসেন বলেন,
“আমার ৯০০ টাকার টিকিট ছিল, সেনাবাহিনী আসার পর ৩০০ টাকা ফেরত পাই। ঈদে এমন নজরদারি থাকলে কেউ অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার সাহস পাবে না।”
ঈদযাত্রা মানেই ভাড়া জুলুম: দীর্ঘদিনের অভিযোগ
বাংলাদেশের পরিবহন খাতে অনিয়ম ও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় নতুন কিছু নয়। বিশেষ করে ঈদ, পূজা, পহেলা বৈশাখ বা জাতীয় দিবসগুলোর আগের ও পরের দিনগুলোতে যাত্রীদের যেন নিঃশেষ করে দেয় ভাড়া জুলুম।
বাংলাদেশ যাত্রী অধিকার পরিষদের এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতি ঈদে গড়ে ৬০%-৮০% পর্যন্ত অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে যেতেও বাধ্য হন, অথচ পুরো ভাড়া আদায় করা হয়।
সাধারণ যাত্রীরা প্রতিবার ভোগান্তি সহ্য করলেও কর্তৃপক্ষের নজরদারি বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ। এই প্রথম সেনাবাহিনীর সরাসরি হস্তক্ষেপে এমন অবস্থা সাময়িকভাবে হলেও পাল্টেছে।
পরিশেষে: সাময়িক অভিযান নয়, চাই স্থায়ী সমাধান
এ ধরনের অভিযান নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু এই সমস্যার মূল প্রতিকার প্রয়োজন নীতিগত ও প্রশাসনিক পরিবর্তনে। শুধু সেনাবাহিনীর দায়িত্ব নয়, সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (BRTA), জেলা প্রশাসন, এবং পুলিশ প্রশাসনকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।
ঈদের সময় নিয়মিত মনিটরিং টিম, জরুরি হেল্পলাইন, ভ্রাম্যমাণ আদালত এবং যাত্রী সচেতনতা বৃদ্ধি করেই কেবল এই অনিয়ম রোধ সম্ভব।
‘সিংহের মতো বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো’ বাভুমা কি আজ ফিরবেন