বাংলাদেশ

বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া নতুন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ইউনূস ও ইব্রাহিমের বৈঠকে ৫ চুক্তি

Advertisement

মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুর ও প্রশাসনিক কেন্দ্র পুত্রজায়ায় অনুষ্ঠিত এই বৈঠককে অনেক কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া সম্পর্কের “নতুন মাইলফলক” হিসেবে অভিহিত করছেন।
সোমবার (১১ আগস্ট ২০২৫) সকালে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী দাতো’ সেরি আনোয়ার ইব্রাহিম নিজ কার্যালয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভ্যর্থনা জানান।

আন্তর্জাতিক প্রোটোকল অনুযায়ী লাল গালিচা সংবর্ধনা, গার্ড অব অনার প্রদান এবং জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় দিনটির আনুষ্ঠানিকতা।
এরপর দুই নেতা একান্ত বৈঠকে বসেন, যেখানে ভবিষ্যৎ সহযোগিতার বিস্তৃত কর্মপরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়।

৫টি সমঝোতা স্মারক (MoU) স্বাক্ষর

বৈঠকের অন্যতম বড় সাফল্য হলো বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা স্মারক (MoU) স্বাক্ষর
এসব চুক্তি ভবিষ্যতে দুই দেশের অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা, জ্বালানি ও বাণিজ্যিক সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

স্বাক্ষরিত ৫টি সমঝোতা স্মারক হলো:

  1. হালাল ইকোসিস্টেম উন্নয়ন – খাদ্য, ঔষধ, প্রসাধনীসহ হালাল শিল্পে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার যৌথ উদ্যোগ।
  2. পররাষ্ট্র একাডেমির মধ্যে সহযোগিতা – কূটনৈতিক প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা বিনিময়।
  3. উচ্চশিক্ষা খাতে সমঝোতা – বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের যৌথ কার্যক্রম, শিক্ষার্থী বিনিময় ও গবেষণা প্রকল্প।
  4. প্রতিরক্ষা সহযোগিতা – সামরিক প্রশিক্ষণ, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উন্নয়ন ও প্রযুক্তি বিনিময়।
  5. জ্বালানি ও নবায়নযোগ্য শক্তি খাতের উন্নয়ন – গ্যাস, তেল, সৌরশক্তি ও বায়ুশক্তি প্রকল্পে বিনিয়োগ।

শ্রমবাজারে নতুন সম্ভাবনা

বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো বহুদিন ধরেই একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও সামাজিক ইস্যু। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু প্রশাসনিক জটিলতার কারণে শ্রমিক নিয়োগ প্রক্রিয়া ধীর হয়ে গিয়েছিল।
বৈঠকে এই সমস্যা দ্রুত সমাধানের ব্যাপারে উভয় পক্ষই একমত হয়েছেন।

মালয়েশিয়া বর্তমানে নির্মাণ, কৃষি, উৎপাদন ও সেবা খাতে প্রচুর বিদেশি শ্রমিক নিয়োগ করে থাকে। বৈঠকের ফলাফল অনুযায়ী, বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য আরও বৃহত্তর ও নিয়মিত নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু হতে পারে, যা রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াবে।

রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা

মালয়েশিয়া বহুদিন ধরেই রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশের পাশে রয়েছে। আনোয়ার ইব্রাহিম পুনরায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তাঁর সরকার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রোহিঙ্গা ইস্যুটি উত্থাপন করে যাবে এবং মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বজায় রাখবে

ড. ইউনূস বৈঠকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন,

“বাংলাদেশ ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। এ সমস্যা সমাধানে মালয়েশিয়ার সহযোগিতা আমাদের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান।”

বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা

বর্তমানে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার বার্ষিক দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই বৈঠকের মাধ্যমে উভয় দেশ বাণিজ্যের পরিমাণ দ্বিগুণ করার লক্ষ্যে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

প্রধান সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো হলো:

  • কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ
  • হালাল সার্টিফিকেশন ব্যবসা
  • পর্যটন ও হসপিটালিটি সেক্টর
  • তথ্যপ্রযুক্তি ও সফটওয়্যার রপ্তানি
  • নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প

সমুদ্র অর্থনীতি ও আসিয়ান সহযোগিতা

বাংলাদেশের সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাবনা নিয়ে মালয়েশিয়া আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে গভীর সমুদ্র বন্দর, মাছ চাষ এবং সামুদ্রিক পর্যটন খাতে বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে।
এছাড়া, বাংলাদেশকে আসিয়ান-এর বিভিন্ন সহযোগী প্রকল্পে যুক্ত করার ব্যাপারে মালয়েশিয়া সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে।

দুই নেতার যৌথ বিবৃতি

বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন,

“বাংলাদেশ আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও কৌশলগত অংশীদার। আজকের বৈঠক আমাদের সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।”

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন,

“আমরা এমন এক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই, যা শুধু আজ নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও উপকারী হবে।”

অতীত সম্পর্কের প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্কের সূচনা হয় ১৯৭২ সালে। তারপর থেকে শিক্ষা, কর্মসংস্থান, বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষাসহ বহু খাতে সহযোগিতা বেড়েছে।
বিশেষ করে শ্রমবাজারে বাংলাদেশি কর্মীরা মালয়েশিয়ার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।

বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ড. ফারুক হাসান বলেন,

“আজকের পাঁচটি সমঝোতা স্মারক শুধু চুক্তি নয়, এগুলো বাস্তবায়ন হলে দুই দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে।”

বাণিজ্য বিশ্লেষক নাসিমা আক্তার মনে করেন,

“হালাল ইকোসিস্টেমে বাংলাদেশ-মালয়েশিয়ার যৌথ উদ্যোগ আমাদের রপ্তানি বাজারে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করবে।”

বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার এই বৈঠক কেবল কূটনৈতিক আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং অর্থনীতি, কর্মসংস্থান, শিক্ষা, প্রতিরক্ষা ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় দীর্ঘমেয়াদী ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এখন দেখার বিষয়, স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলো কত দ্রুত ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়।

MAH – 12264 ,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button