বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা

বাংলাদেশে রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যেই নির্বাচন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর সরকারি বাসভবন ‘যমুনা’য় তিনি পৃথকভাবে বৈঠকে বসেন দেশের তিনটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে। বৈঠকে অংশ নেয় বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
তিনটি দলই জাতীয় নির্বাচনের সময়সূচি ও রোডম্যাপ পরিষ্কারভাবে জানতে চায়। বিএনপি দ্রুত নির্বাচন ও বিতর্কিত উপদেষ্টাদের পদত্যাগ দাবি করে, জামায়াত চায় নির্বাচনের পূর্বে দৃশ্যমান সংস্কার ও বিচার প্রক্রিয়া, আর এনসিপি তাদের নিজস্ব কিছু রাজনৈতিক সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয়।
বিএনপির অবস্থান: ডিসেম্বরেই নির্বাচন ও তিন উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি
প্রথমে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় বিএনপির একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল বৈঠকে অংশ নেয়। উপস্থিত ছিলেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সালাহউদ্দিন আহমদ। বৈঠকে বিএনপি লিখিত বক্তব্য তুলে দেয় প্রধান উপদেষ্টার হাতে।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, “সংসদ নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করতে হলে প্রথমেই বিতর্কিত উপদেষ্টাদের সরিয়ে উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠন করতে হবে।” এই দাবির পাশাপাশি ডিসেম্বর ২০২৫-এর মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের জন্য একটি নির্দিষ্ট রোডম্যাপ প্রকাশের দাবি জানানো হয়।
বিএনপির পক্ষ থেকে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “আমরা আমাদের দাবি জানিয়েছি, এখন প্রধান উপদেষ্টা কী বলেন, সেটা দেখার অপেক্ষা।” তিনি আরও জানান, তাঁরা জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এবং তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের পদত্যাগ দাবি করেছেন।
জামায়াতের প্রশ্ন: “নির্বাচনটা কবে হবে?”
বিএনপির পর রাত সাড়ে নয়টার দিকে বৈঠকে বসে জামায়াতে ইসলামি। দলের আমির শফিকুর রহমান ও নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বৈঠকে অংশ নেন। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে শফিকুর রহমান বলেন, “আমরা দুটি বিষয় স্পষ্ট করার অনুরোধ করেছি—এক, নির্বাচন কবে হবে; দুই, নির্বাচনের আগে সংস্কার ও বিচার প্রক্রিয়া দৃশ্যমানভাবে সম্পন্ন করতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “সংস্কার না করে নির্বাচন করলে জনগণের আশা পূরণ হবে না। আবার সব সংস্কার এক সরকারের পক্ষে সম্ভবও নয়।”
জামায়াতের আমির অভিযোগ করেন, প্রধান উপদেষ্টা এর আগেও নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে বলেছেন, কিন্তু আজ অবধি কোনো নির্দিষ্ট রোডম্যাপ, মাস বা সপ্তাহের ঘোষণা দেননি।
এছাড়া তিনি জানান, গত বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয়নি। বরং তা ঘিরে দেশে আতঙ্ক ও গুঞ্জনের সৃষ্টি হয়। তিনি বলেন, “এটা নিয়ে আমরাও যেমন উদ্বিগ্ন, জাতিও তেমনি উদ্বিগ্ন।”
এনসিপির প্রস্তাব: সংস্কার ও বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা চায় দলটি
তৃতীয় ও শেষ দলে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলের পক্ষ থেকে আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব ও যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে এনসিপি তাদের নিজস্ব কিছু সাংবিধানিক সংস্কার ও বিচার সংশ্লিষ্ট প্রস্তাব তুলে ধরে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।
উপদেষ্টা পরিষদের বিতর্ক: পদত্যাগ দাবির পেছনে রাজনীতি?
বিএনপির দাবি করা তিন উপদেষ্টার পদত্যাগ প্রসঙ্গে রাজনীতিক মহলে নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই দাবি বাস্তবায়ন হলে অন্তর্বর্তী সরকারের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি বলছে, এই উপদেষ্টারা সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ করছেন।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজও, যিনি জানিয়েছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি ও পরামর্শগুলো গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছেন তাঁরা।
সামনে কী আসছে?
প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার জানিয়েছেন, আজ রবিবার আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করবেন ড. ইউনূস। এরপর আগামী সপ্তাহেই তিনি সাংবাদিক সম্মেলনে নির্বাচন রোডম্যাপ বা সময়সূচি ঘোষণা করতে পারেন বলে আভাস মিলেছে।
বিশ্লেষণ: সামনে কি রাজনৈতিক সমঝোতা, না উত্তেজনার বিস্ফোরণ?
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়ে উত্তেজনা নতুন নয়। তবে এবারের পরিস্থিতি আলাদা। একটি দল চায় ডিসেম্বরেই ভোট, অন্যরা চায় সংস্কার; আর সরকার রোডম্যাপ দিতে টালবাহানা করছে—এই বাস্তবতায় সমঝোতার পথে না গেলে আবারও বড় রাজনৈতিক সংঘাতের মুখে পড়তে পারে দেশ।
বিএনপি ও জামায়াতের মতো বিরোধী দলগুলো একদিকে চাপে রেখেছে অন্তর্বর্তী সরকারকে, অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য বা অনিশ্চিত সিদ্ধান্ত দেশজুড়ে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।
এখন দেখার বিষয়, ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকার সময়মতো বিশ্বাসযোগ্য রোডম্যাপ দিতে পারে কিনা। কেননা জাতি অপেক্ষা করছে—একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আশায়।