বানিজ্য

৩২৬৭ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক

বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে ৩২৬৭ কোটি টাকা বা ২৭ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দিচ্ছে, যা দেশের দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলে পুনরুদ্ধার, পুনর্গঠন এবং ভবিষ্যৎ দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ব্যয় করা হবে। এই অর্থায়ন একদিকে যেমন গত বছরের ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর জন্য স্বস্তির বার্তা নিয়ে এসেছে, তেমনি ভবিষ্যতের জন্য দুর্যোগ সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণে নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্ছে।

প্রকল্পের নাম ও মূল লক্ষ্য

বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়িত হতে যাওয়া প্রকল্পটির নাম ‘বাংলাদেশ সাসটেইনেবল রিকোভার, ইমার্জেন্সি প্রিপারিডনেস অ্যান্ড রেসপন্স’, সংক্ষেপে বি-স্ট্রং (B-STRONG)। প্রকল্পটির লক্ষ্য হলো চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের বন্যা কবলিত গ্রামীণ এলাকাগুলোতে টেকসই অবকাঠামো নির্মাণ ও পুনর্বাসনের মাধ্যমে মানুষের জীবন ও জীবিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করা।

বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, এই প্রকল্পের আওতায় প্রায় ১৬ লাখ মানুষ সরাসরি উপকৃত হবেন। বন্যার সময়ে তাদের জীবন, সম্পদ এবং খাদ্য নিরাপত্তা রক্ষায় কার্যকর অবকাঠামো ও প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে।

অর্থ ব্যয়ের খাতসমূহ

প্রকল্পটিকে কয়েকটি বড় খাতে ভাগ করে অর্থ ব্যয় করা হবে। এর মধ্যে রয়েছে:

  • ৭৯টি বহুমুখী বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ ও পুনঃসংস্কার
    আশ্রয়কেন্দ্রগুলো বন্যার সময় নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে ব্যবহৃত হবে এবং স্বাভাবিক সময়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে কাজ করবে।
  • জলবায়ু সহিষ্ণু সংযোগ সড়ক ও সেতু নির্মাণ
    গ্রামের সঙ্গে শহরের যোগাযোগ রক্ষা এবং জরুরি সহায়তা দ্রুত পৌঁছে দিতে এসব অবকাঠামো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
  • বন্যা সুরক্ষা বাঁধ নির্মাণ, মেরামত ও খাল পুনর্খনন
    দীর্ঘমেয়াদি বন্যা প্রতিরোধে টেকসই ব্যবস্থা হিসেবে এই অবকাঠামোগুলো কার্যকর হবে।
  • দুর্যোগ পূর্বাভাস ব্যবস্থা উন্নয়ন
    আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা আরও আধুনিক ও কার্যকর করে তোলা হবে যাতে মানুষ সময়মতো আশ্রয় নিতে পারে।
  • স্থানীয় জনগণকে প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জাম প্রদান
    নৌকা, উদ্ধার সরঞ্জাম ও নিয়মিত মহড়ার মাধ্যমে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রস্তুতিমূলক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হবে।

প্রকল্পের গুরুত্ব ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

বিশ্বব্যাংকের অন্তর্বর্তীকালীন কান্ট্রি ডিরেক্টর গেইল মার্টিন বলেন, “বাংলাদেশ জলবায়ু অভিযোজন এবং দুর্যোগ প্রস্তুতিতে বৈশ্বিক অগ্রদূত। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জলবায়ু ঝুঁকি এবং ঘন ঘন দুর্যোগ দেশের অর্থনীতি ও জনগণের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে। তাই এ ধরনের প্রকল্প বাংলাদেশকে ভবিষ্যতের জন্য আরও প্রস্তুত করে তুলবে।”

তিনি আরও বলেন, সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের বহু মানুষ গত বছরের বন্যায় চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন। তাদের পুনরুদ্ধার নিশ্চিত করা এবং ভবিষ্যতের ঝুঁকি কমানো এখন সময়ের দাবি।

বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, প্রকল্পটি শুধুমাত্র অবকাঠামো নির্মাণে সীমাবদ্ধ থাকবে না। এটি একটি সামগ্রিক উদ্যোগ, যা দুর্যোগ পূর্বাভাস, স্থানীয় প্রস্তুতি এবং পুনরুদ্ধার কার্যক্রমকে একত্রিত করে দীর্ঘমেয়াদে সহনশীলতা তৈরি করবে।

সমন্বিত পরিকল্পনা ও অভৌত কার্যক্রমের সমন্বয়

প্রকল্পের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ভৌত অবকাঠামোর পাশাপাশি অভৌত বা নন-ফিজিক্যাল কার্যক্রমের গুরুত্ব দেওয়া। এর মাধ্যমে শুধু ভবন বা বাঁধ নয়, বরং জনসচেতনতা, প্রশিক্ষণ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বাড়ানো হবে।

বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র ডিজাস্টার রিস্ক ম্যানেজমেন্ট স্পেশালিস্ট স্বর্ণা বলেন, “প্রকল্পটি একই সঙ্গে পুনরুদ্ধার ও স্থিতিশীলতার বিষয়টিকে সমন্বিতভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি ভবিষ্যতের জন্য টেকসই এবং কার্যকর পথনির্দেশনা তৈরি করবে।”

তিনি আরও বলেন, দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস ও সহনশীলতা তৈরির ক্ষেত্রে প্রকল্পটি একটি উদাহরণ হবে। এর মাধ্যমে দুর্বল জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়া এবং ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

জাতীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব

বিশ্বব্যাংকের এই অর্থায়ন শুধু একক কোনো প্রকল্পে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি বড় অর্থনৈতিক ও সামাজিক উদ্যোগের অংশ। দেশের প্রান্তিক ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য এই সহায়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তারা বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হন।

এই প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন হলে তা হবে বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় একটি মাইলফলক। এটি জাতীয় পরিকল্পনায় ‘বন্যা সহনশীল অবকাঠামো’ ও ‘জলবায়ু অভিযোজন’ উদ্যোগের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাস্তবায়িত হবে।

ঋণের শর্ত ও পর্যালোচনা

বিশ্বব্যাংকের এই ঋণ স্বল্পসুদে এবং দীর্ঘমেয়াদি। তবে অর্থ ছাড়ের ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট শর্ত আরোপ করা হয়েছে, যার মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি, স্বচ্ছতা ও দক্ষতা অন্যতম।

বিশ্বব্যাংক স্পষ্ট করেছে, যদি নির্ধারিত শর্ত বাস্তবায়নে ঘাটতি থাকে, তবে ঋণের অর্থ ছাড় আটকে দেওয়া হতে পারে। এ কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর জন্য এটি একটি বড় দায়িত্ব।

উপসংহার

বিশ্বব্যাংকের এই ৩২৬৭ কোটি টাকার ঋণ বাংলাদেশের দুর্যোগ মোকাবিলা ও জলবায়ু অভিযোজন পরিকল্পনায় এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এটি শুধু একটি আর্থিক সহায়তা নয়, বরং একটি টেকসই উন্নয়নের রোডম্যাপ। সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই প্রকল্প লাখো মানুষের জীবন ও জীবিকা রক্ষায় একটি কার্যকর মডেল হয়ে উঠতে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button