বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক নির্ভরতা কমাচ্ছে সরকার

২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো হচ্ছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যেখানে ব্যাংক খাত থেকে প্রায় ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ছিল, সেখানে আগামী অর্থবছরে এ পরিমাণ ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্র জানায়, বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হতে পারে এবং বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৪.২ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ঘাটতি মেটাতে দেশি ও বিদেশি ঋণ দুই উৎস থেকেই অর্থ সংগ্রহ করা হবে, তবে ব্যাংকের ওপর নির্ভরতা কমানোর লক্ষ্যে বিকল্প উৎস যেমন সঞ্চয়পত্র ও বৈদেশিক ঋণের দিকে ঝুঁকছে সরকার।
কেন কমানো হচ্ছে ব্যাংকঋণ?
ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার একাধিক নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। এর ফলে:
- বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ কমে যায় – বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সরকারের কাছে ঋণ দেওয়ার পর বেসরকারি উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণের পরিমাণ ও সক্ষমতা হ্রাস পায়।
- মুদ্রাস্ফীতির চাপ বাড়ে – কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরাসরি ঋণ নেওয়ার ফলে অর্থনীতিতে অতিরিক্ত মুদ্রা প্রবাহিত হয়, যা মূল্যস্ফীতিকে ত্বরান্বিত করে।
- সুদ বাবদ ব্যয় বেড়ে যায় – ব্যাংকঋণের বিপরীতে সরকারকে বিশাল অঙ্কের সুদ পরিশোধ করতে হয়, যা মূলত রাজস্ব আয় থেকেই মেটাতে হয়।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “ব্যাংকঋণ বেশি হলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ব্যাহত হয় এবং সরকারের সুদ ব্যয় বাড়ে। তাই আগামী বাজেটে এ বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন জরুরি।”
ঘাটতি পূরণে বিকল্প উৎস
আগামী বাজেটে ঋণের বিকল্প উৎস হিসেবে গুরুত্ব পাচ্ছে সঞ্চয়পত্র ও বৈদেশিক ঋণ।
- সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে: চলতি বছরে ১৫ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও, আগামী অর্থবছরে তা বাড়িয়ে ২০ হাজার কোটি টাকা করা হচ্ছে।
- বৈদেশিক ঋণ: নিট বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণের পরিকল্পনা রয়েছে। চার বছরের ব্যবধানে দেশের বৈদেশিক ঋণ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ৮ লাখ ১২ হাজার ৭৭ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
ঋণের বর্তমান চিত্র
অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশের মোট দেশি-বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩২ হাজার ২৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে:
- অভ্যন্তরীণ ঋণ: ১০ লাখ ২০ হাজার ২০৫ কোটি টাকা
- বিদেশি ঋণ: ৮ লাখ ১২ হাজার ৭৭ কোটি টাকা
অভ্যন্তরীণ ঋণ বিশেষত ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের জন্য সরকারকে বড় অঙ্কের সুদ পরিশোধ করতে হয়। এ খাতেই আগামী বাজেটে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে এক লাখ কোটি টাকার বেশি।
রাজস্ব ঘাটতিই মূল সংকট
সাবেক অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, “আমাদের মূল সমস্যা রাজস্ব আদায়ে। যদি রাজস্ব আয় বাড়ানো যেত, তাহলে সরকারকে এত বেশি ঋণ নিতে হতো না।” তিনি আরও বলেন, “সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে কারণ এর মুনাফার হার সম্প্রতি বৃদ্ধি পেয়েছে।”
বিশ্বে বাংলাদেশের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত অন্যতম নিম্নতম। এ কারণে সরকারের ব্যয় সামর্থ্য সীমিত হয়ে পড়ে, যার প্রভাব পড়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দে।
মূল্যস্ফীতির চাপে সরকার
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল ২০২৫ মাসে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯.১৭ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির অন্যতম একটি কারণ হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ। এটি জনগণের জীবনযাত্রা ব্যয় আরও বাড়িয়ে তোলে।
তবে স্বস্তির বিষয় হলো, সরকার ঘোষিত ঋণের লক্ষ্যমাত্রার পুরোটা শেষ পর্যন্ত ব্যাংক থেকে গ্রহণ করে না। যেমন চলতি অর্থবছরে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৯৯ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে।
সার্বিক মূল্যায়ন
২০২৫-২৬ অর্থবছরে সরকারের পরিকল্পনায় সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে ঋণ কাঠামোকে ভারসাম্যপূর্ণ করার একটি প্রয়াস। ব্যাংক খাতের ওপর চাপ কমিয়ে বিকল্প উৎস যেমন সঞ্চয়পত্র ও বৈদেশিক ঋণ ব্যবহারে জোর দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধিকে উৎসাহিত করাও এ নীতির অন্যতম লক্ষ্য।
সিপিডি’র মতে, টেকসই বাজেট বাস্তবায়নে মূল চ্যালেঞ্জ হলো রাজস্ব আহরণ বাড়ানো। এটি সম্ভব হলে সরকারকে ঋণ নির্ভরতা কমিয়ে সামাজিক খাতে আরও বেশি ব্যয় বরাদ্দের সুযোগ তৈরি হবে।
আগামী অর্থবছরে সরকারের ব্যাংকঋণ সীমিত করার উদ্যোগ দেশের আর্থিক খাতের জন্য ইতিবাচক বার্তা বহন করছে। সঠিক বাস্তবায়ন, রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির উদ্যোগ ও ব্যয় ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা বজায় রাখতে পারলে সামষ্টিক অর্থনীতিতে এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী।