বানিজ্য

ঈদের এক মাস আগেই মসলার দামে আগুন

কুরবানির ঈদের আর মাত্র এক মাস বাকি। এ সময়ে মাংসসহ বিভিন্ন পদের খাবার রান্নার জন্য মসলার চাহিদা বাড়ে। কিন্তু ঈদের এক মাস আগেই মসলার বাজারে দেখা দিয়েছে তীব্র অস্থিরতা। পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ, এলাচ, জিরা, লবঙ্গসহ প্রায় সব ধরনের মসলার দাম বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। এই দাম বৃদ্ধি ভোক্তাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে, বিশেষ করে সাধারণ ও নিম্ন-আয়ের মানুষের জন্য এটি একটি বড় চাপ। বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজার ঘুরে এবং ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

মসলার দামে উল্লম্ফন: কী বলছে বাজার?

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, দেশি পেঁয়াজের দাম গত সপ্তাহের তুলনায় কেজিপ্রতি ৫ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। বৃহস্পতিবার প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৫৫ থেকে ৬৫ টাকায়, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৫০ থেকে ৬০ টাকা। পাড়া-মহল্লার মুদি দোকানে এই দাম আরও বেশি, কোথাও কোথাও ৭০ টাকা পর্যন্ত। দেশি রসুনের কেজি এক মাস আগে ৮০ টাকা হলেও এখন বিক্রি হচ্ছে সর্বনিম্ন ১১০ টাকায়। আমদানি করা রসুনের দাম আরও চড়া, কেজিপ্রতি ১৮৫ থেকে ২৪০ টাকা।

আদার দামও বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। দেশি আদা বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি, আর আমদানি করা আদার দাম ২০০ থেকে ২২০ টাকা, যা গত মাসের তুলনায় ২০ টাকা বেশি। হলুদের কেজি মানভেদে ২৫০ থেকে ৪২০ টাকা, যা এক মাস আগে ছিল ২৩০ থেকে ৪০০ টাকা। শুকনা মরিচের দামও বেড়েছে, দেশি শুকনা মরিচ কেজিপ্রতি ৩৩০ টাকা এবং আমদানি করা শুকনা মরিচ ৩৩০ থেকে ৪৩০ টাকা।

গরম মসলার মধ্যে এলাচের দামে এসেছে বড় ধরনের পরিবর্তন। ছোট দানার এলাচ বিক্রি হচ্ছে ৪৬০০ থেকে ৫৩০০ টাকা কেজি, যা এক মাস আগে ছিল ৪৫০০ থেকে ৫১০০ টাকা। জিরার দাম কেজিপ্রতি ৬৫০ থেকে ৭৫০ টাকা, দারুচিনি ৫৫০ থেকে ৫৮০ টাকা, এবং লবঙ্গ ১৪০০ থেকে ১৬০০ টাকা। এই দাম বৃদ্ধির ফলে ভোক্তাদের বাজার ব্যাগের ওজন কমছে, কিন্তু খরচ বাড়ছে।

কেন বাড়ছে দাম?

মসলার দাম বৃদ্ধির পেছনে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করছেন। বাংলাদেশের মসলার বাজার মূলত আমদানিনির্ভর। সম্প্রতি ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি খরচ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ১১০ থেকে ১১৭ টাকা নির্ধারণ করেছে, যার প্রভাব পড়েছে মসলার আমদানি খরচে। এছাড়া, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, পরিবহন খরচ বৃদ্ধি, এবং রপ্তানিকারক দেশগুলোতে মসলার দাম বৃদ্ধিও এই অস্থিরতার জন্য দায়ী।

কাওরান বাজারের একজন পাইকারি ব্যবসায়ী ইলিয়াস বলেন, “পাইকারি বাজারে মসলার কোনো ঘাটতি নেই, সরবরাহও স্বাভাবিক। কিন্তু আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় আমাদের বেশি দামে কিনতে হচ্ছে, তাই বিক্রিও বেশি দামে করতে হচ্ছে।” তিনি আরও জানান, কুরবানির ঈদের সময় মসলার চাহিদা বাড়ে, আর এই সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী দাম বাড়িয়ে দেন।

ভোক্তাদের অসন্তোষ ও দাবি

রাজধানীর কাওরান বাজারে কেনাকাটা করতে আসা মো. মোহাইমিনুল ইসলাম বলেন, “প্রতি ঈদের আগেই মসলার দাম বাড়ে। এটা যেন ব্যবসায়ীদের জন্য নিয়মে পরিণত হয়েছে। বাজারে পণ্যের কোনো ঘাটতি নেই, তবুও দাম বাড়ানো হচ্ছে। সরকারের উচিত এখনই কার্যকর তদারকি করে বাজার নিয়ন্ত্রণে আনা।”

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, “প্রতি বছর কুরবানির ঈদের আগে মসলার দাম বাড়ানো একটি চিরাচরিত প্রক্রিয়া। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এই সময়ে অতিরিক্ত মুনাফার লোভে দাম বাড়ায়। সরকারের উচিত এখন থেকেই কঠোর তদারকির মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণে আনা।”

অন্যান্য নিত্যপণ্যের দামও বাড়ছে

মসলার পাশাপাশি চাল, মুরগি, এবং মাংসের দামেও অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। খুচরা বাজারে মিনিকেট চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮৭ থেকে ৮৮ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৮৫ টাকা। পাইজাম চালের কেজি ৬৫ টাকা, আর স্বর্ণা জাতের মোটা চাল ৫২ থেকে ৫৫ টাকা। ব্রয়লার মুরগির দাম গত সপ্তাহের তুলনায় বেড়ে ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা কেজি। দেশি মুরগির দাম ৫০০ থেকে ৬৬০ টাকা, গরুর মাংস ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা, এবং খাসির মাংস ১১০০ থেকে ১২৫০ টাকা কেজি।

মালিবাগ কাঁচাবাজারের চাল বিক্রেতা মো. দিদার হোসেন বলেন, “এখন আমন মৌসুমের চাল শেষের দিকে। বোরো চাল বাজারে পুরোদমে আসতে এখনো কিছুটা সময় লাগবে। তাই চালের দাম কিছুটা বেশি। নতুন চাল বাজারে এলে দাম কমে যাবে।”

বাজার নিয়ন্ত্রণে কী করা উচিত?

মসলা ও অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষের ওপর। কুরবানির ঈদের সময় পরিবারগুলোতে খরচ বাড়ে, আর এই সময়ে দাম বৃদ্ধি তাদের জন্য অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের তদারকি জোরদার করা জরুরি। এছাড়া, আমদানি খরচ কমাতে ডলারের বিনিময় মূল্য স্থিতিশীল রাখা এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

চট্টগ্রাম মসলা আমদানিকারক সমিতির সভাপতি অমর কান্তি দাস বলেন, “মসলার বাজার সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর। দাম বৃদ্ধির পেছনে ডলারের দাম, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, এবং রপ্তানিকারক দেশে দাম বৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, ঈদের সময় চাহিদা বাড়ার সুযোগ নিয়ে কিছু ব্যবসায়ী অতিরিক্ত দাম বাড়ায়, যা নিয়ন্ত্রণে সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।”

উপসংহার

কুরবানির ঈদের আগে মসলার দাম বৃদ্ধি বাংলাদেশের বাজারে একটি পুনরাবৃত্তিমূলক সমস্যা। এই বৃদ্ধি শুধু ভোক্তাদের জন্যই নয়, খুচরা ব্যবসায়ীদের জন্যও চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে, কারণ বাড়তি দামের কারণে বিক্রি কমছে। সরকার, ব্যবসায়ী সমিতি, এবং ভোক্তা অধিকার সংগঠনগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাজারে স্থিতিশীলতা আনা সম্ভব। ঈদের আনন্দ যেন দাম বৃদ্ধির কারণে ম্লান না হয়, সেজন্য এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button