ব্যাংক লোকসান করলে মালিকরা লভ্যাংশ এবং কর্মকর্তারা বোনাস পাবে না: গভর্নর

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর ঘোষণা দিয়েছেন, যে সব ব্যাংক লোকসান করবে সেসব ব্যাংকের মালিকরা লভ্যাংশ এবং কর্মকর্তারা বোনাস পাবেন না। শনিবার রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে “অর্থনীতিতে প্রবাসীদের অবদান” শীর্ষক সেমিনারে তিনি এই বক্তব্য দেন।
গভর্নর বলেন, দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ব্যাংক খাতে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। লোকসানী ব্যাংক যদি মালিক ও কর্মকর্তাদের আর্থিক সুবিধা দিতে থাকে, তাহলে তা জনগণের আমানতকারীদের প্রতি অন্যায্য আচরণ হবে।
কেন এমন সিদ্ধান্ত
ব্যাংক খাতে দীর্ঘদিন ধরে লোকসান, খেলাপি ঋণ ও অনিয়মের অভিযোগ উঠে আসছে। এর ফলে অনেক ব্যাংক লোকসানের মুখে পড়লেও মালিক ও কর্মকর্তারা বিভিন্ন অজুহাতে বোনাস এবং লভ্যাংশ তুলে নিচ্ছিলেন। এই পরিস্থিতি বন্ধ করতেই বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোর অবস্থান নিয়েছে। গভর্নরের মতে, “লোকসান হলে সবাইকে দায় নিতে হবে, শুধু আমানতকারীর কাঁধে চাপানো যাবে না।”
প্রবাসী আয়ে ইতিবাচক প্রভাব
একই অনুষ্ঠানে গভর্নর জানান, সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ ২৯ শতাংশ বেড়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, অর্থ পাচার কমে আসায় এবং প্রবাসীদের আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে টাকা পাঠানো বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। তার ভাষায়, “দেশে এখন ডলারের সংকট নেই, তবে টাকার সংকট রয়েছে।”
এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থনৈতিক খাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে এবং অনেক ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই সফলতা এসেছে বলেও তিনি দাবি করেন।
ব্যাংক একীভূতকরণের উদ্যোগ
গভর্নর আহসান এইচ মনসুর আরও জানান, দেশের পাঁচটি ইসলামি ব্যাংক একীভূত করে একটি বৃহৎ ইসলামী ব্যাংক গঠনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আগামীকাল থেকে সরকারের সাথে আলোচনা শুরু হবে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা আনা, ঝুঁকি কমানো এবং সেবার মান উন্নত করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
পূর্বপটভূমি: ব্যাংক খাতে অনিয়ম ও সমালোচনা
বাংলাদেশের ব্যাংক খাত গত কয়েক বছর ধরে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও খেলাপি ঋণের কারণে সমালোচিত হয়ে আসছে। অনেক ব্যাংক লোকসান করলেও মালিক ও পরিচালনা পর্ষদ লভ্যাংশ নিয়েছে, কর্মকর্তারাও নিয়মিত বোনাস পেয়েছেন। এতে সাধারণ আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং ব্যাংক খাতের প্রতি আস্থা কমেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশ কয়েকটি সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। এবার লোকসানী ব্যাংকে লভ্যাংশ ও বোনাস বন্ধের ঘোষণা সেই সংস্কারের ধারাবাহিক অংশ।
প্রভাব: কারা কীভাবে প্রভাবিত হবে
এই সিদ্ধান্তের ফলে সরাসরি প্রভাব পড়বে ব্যাংকের মালিক ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ওপর। তারা লোকসান হলে আর্থিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। অন্যদিকে সাধারণ আমানতকারীরা কিছুটা আশ্বস্ত হবেন, কারণ তাদের অর্থ ব্যবহারে বাড়বে জবাবদিহিতা।
তবে সমালোচকরা বলছেন, ব্যাংকের আর্থিক দুরবস্থার মূল কারণ দুর্বল ঋণ নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবিত সিদ্ধান্ত। শুধুমাত্র বোনাস ও লভ্যাংশ বন্ধ করলে সমস্যার মূলে পৌঁছানো সম্ভব নাও হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
অর্থনীতিবিদদের মতে, গভর্নরের এই ঘোষণা ব্যাংক খাতে একটি ইতিবাচক বার্তা। এটি মালিক ও কর্মকর্তাদের জবাবদিহি বাড়াবে এবং ঝুঁকি কমাবে। তবে দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংক খাতের সংস্কারের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ যেমন—খেলাপি ঋণ কমানো, সুদের হার যৌক্তিক করা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।
একজন বিশ্লেষক বলেন, “লোকসানী ব্যাংকে বোনাস বন্ধ অবশ্যই ভালো উদ্যোগ, তবে ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা আনতে আরও বড় ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তন প্রয়োজন।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের নতুন ঘোষণা নিঃসন্দেহে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা আনার একটি সাহসী পদক্ষেপ। লোকসান হলে মালিক ও কর্মকর্তারা বোনাস বা লভ্যাংশ পাবেন না—এই নীতি সাধারণ জনগণের আস্থা কিছুটা ফিরিয়ে আনবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে চূড়ান্ত ফলাফল নির্ভর করবে এই সিদ্ধান্ত কতটা কঠোরভাবে বাস্তবায়িত হয় এবং এর সাথে আর কী ধরনের সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয় তার ওপর।
এম আর এম – ১২০১, Signalbd.com