ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের আশঙ্কা তীব্র, বাড়ছে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও সমরসজ্জা

কাশ্মীর ইস্যুতে ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার পুরনো বৈরিতা। সম্প্রতি ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর পরিস্থিতি হঠাৎ করেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ভারত সরাসরি পাকিস্তানের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছে, যদিও ইসলামাবাদ তা জোরালোভাবে অস্বীকার করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলার পর দুই দেশের মধ্যে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল, এবারের পরিস্থিতি তার চেয়েও জটিল এবং বিপজ্জনক। কারণ, এবার উভয় দেশই তাদের সামরিক শক্তি ও প্রযুক্তিতে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন ঘটিয়েছে। সামরিক মহড়া, পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ, সীমান্তে সেনা মোতায়েন—সব কিছু মিলে যুদ্ধ পরিস্থিতির ঝুঁকি কয়েক গুণ বেড়ে গেছে।
পূর্ব অভিজ্ঞতা ও বর্তমান উত্তেজনার উৎস
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুলওয়ামায় আত্মঘাতী হামলায় ৪০ জন ভারতীয় আধা-সামরিক সদস্য নিহত হন। এরপর ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বিমান হামলা চালায় এবং পাল্টা জবাবে পাকিস্তান ভারতীয় একটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে। দুই দিন ধরে সীমান্তে ভয়াবহ উত্তেজনার পর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও, এবারের পেহেলগাম হামলা আবারো নতুন করে সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি করেছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি সেনাবাহিনীকে ‘অভিযান চালানোর পূর্ণ স্বাধীনতা’ দিয়েছেন। অপরদিকে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির বলেছেন, “ভারত যদি আক্রমণ করে, তাহলে কঠোর জবাব দেওয়া হবে।” ইসলামাবাদ দাবি করছে, তাদের হাতে রয়েছে ভারতের সম্ভাব্য হামলার ‘বিশ্বাসযোগ্য তথ্য’।
সামরিক আধুনিকায়নে ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিযোগিতা
২০১৯ সালের পর উভয় দেশই তাদের সামরিক সরঞ্জাম ও কৌশলে অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হল:
ভারতের আধুনিকায়ন:
- ফ্রান্স থেকে ৩৬টি অত্যাধুনিক রাফাল যুদ্ধবিমান সংগ্রহ, যার মধ্যে ২৬টি সম্প্রতি নৌবাহিনীর জন্য কেনা হয়েছে।
- রাফালে রয়েছে ‘মেটিওর’ নামের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, যা শত্রু যুদ্ধবিমান ধ্বংসে সক্ষম।
- রাশিয়ার তৈরি এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সংযুক্ত করা হয়েছে, যা যুদ্ধক্ষেত্রে বেশ কার্যকর।
পাকিস্তানের পাল্টা উদ্যোগ:
- চীনের কাছ থেকে অন্তত ২০টি জে-১০সি যুদ্ধবিমান সংগ্রহ করেছে, যা রাফালের সক্ষমতার কাছাকাছি বলে দাবি।
- এই বিমান পিএল-১৫ দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র বহন করতে পারে।
- চীনের তৈরি এইচকিউ-৯ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যুক্ত করেছে, যা এস-৩০০ ভিত্তিক হলেও এস-৪০০-এর তুলনায় একটু পিছিয়ে।
ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রে আধিপত্যের প্রতিযোগিতা
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এবার সরাসরি বিমান যুদ্ধের পরিবর্তে ড্রোন ও ভূমি থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহারের সম্ভাবনাই বেশি। কারণ এতে পাইলট ধরা পড়ার ঝুঁকি নেই।
ভারতের প্রস্তুতি:
- ইসরায়েলের কাছ থেকে ‘হেরন মার্ক-২’ কমব্যাট ড্রোন কেনার প্রক্রিয়া চলছে।
- যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ‘হান্টার-কিলার প্রিডেটর’ ড্রোন কেনার চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে।
পাকিস্তানের প্রস্তুতি:
- ইতোমধ্যে তুরস্কের বাইরাকতার টিবি-২ ও উন্নত আকিনচি ড্রোন সংগ্রহ করেছে।
- বাইরাকতার ড্রোন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে কার্যকারিতার প্রমাণ দিয়েছে।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাই এখন মুখ্য
চীন পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী। অপরদিকে, যুক্তরাষ্ট্র এখন ভারতের গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংঘাত ছড়িয়ে পড়লে তা শুধুমাত্র ভারত-পাকিস্তান সীমিত থাকবে না, বরং এটি চীন ও পশ্চিমা প্রযুক্তির পরোক্ষ সংঘর্ষে পরিণত হতে পারে।
গবেষক মোহাম্মদ ফয়সাল বলেন, “এই সংঘাত শুধু দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বৃহৎ প্রযুক্তিগত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রূপ নিতে পারে।”
পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের আশঙ্কা কতটা?
উভয় দেশেরই পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, কোনো পক্ষই দেয়ালে পিঠ না ঠেকা পর্যন্ত পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের কথা ভাববে না। কিন্তু সীমিত সংঘাত যে মুহূর্তে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে, সে আশঙ্কা অস্বীকার করা যাচ্ছে না।
ভারতের সাবেক এয়ার ভাইস মার্শাল অনিল গোলানি বলেন, “দেশজুড়ে এখন অনেকেই কঠোর প্রতিক্রিয়া চাইছেন। তবে আমি মনে করি, দুই দেশই পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ চায় না।”
উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ভূমিকা জরুরি
বর্তমান প্রেক্ষাপটে ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের পক্ষেই সংঘাতে জড়ানো ধ্বংসাত্মক হতে পারে। সীমান্তে সামরিক মহড়া, নতুন অস্ত্র সংগ্রহ এবং পাল্টাপাল্টি বক্তব্য পরিস্থিতিকে আরো উত্তপ্ত করছে। তাই আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও বৈশ্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে জরুরি ভিত্তিতে কূটনৈতিক আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।