ভারতের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে যাচ্ছে পাকিস্তান

ভারতের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে পাকিস্তান। ভারতের বিরুদ্ধে চেনাব নদীর পানিপ্রবাহ কমানোর অভিযোগ তুলে এবং সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে পাকিস্তান এই কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছে। ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে গত ২২ এপ্রিলের একটি সন্ত্রাসী হামলাকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে, যা এই সংকটকে আরও জটিল করে তুলেছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা জাতিসংঘে ভারতের “আগ্রাসী কর্মকাণ্ড” এবং “উসকানিমূলক বক্তব্য” নিয়ে অভিযোগ তুলবে।
পেহেলগাম হামলা: উত্তেজনার সূত্রপাত
গত ২২ এপ্রিল ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে একটি সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হন, যাদের অধিকাংশই ছিলেন পর্যটক। এটি ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার পর ভারতের মাটিতে সবচেয়ে মারাত্মক সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ভারত দাবি করেছে, এই হামলার পেছনে পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাত রয়েছে এবং পাকিস্তান সরকার এই হামলাকে পরোক্ষভাবে সমর্থন দিয়েছে। এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে ভারত পাকিস্তানি কূটনীতিকদের বহিষ্কার, সীমান্ত বন্ধ, পাকিস্তানি নাগরিকদের ভিসা বাতিল এবং সর্বোপরি ১৯৬০ সালের সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
পাকিস্তান এই অভিযোগ দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, পেহেলগাম হামলার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই এবং ভারত কোনো প্রমাণ ছাড়াই অভিযোগ তুলছে। পাকিস্তানের সিনেটে এই বিষয়ে আলোচনার সময় দেশটির নেতারা ভারতের বিরুদ্ধে “উসকানিমূলক” আচরণের অভিযোগ তুলেছেন এবং যেকোনো সামরিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কঠোর জবাব দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
সিন্ধু পানিচুক্তি: একটি ঐতিহাসিক চুক্তির সংকট
১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত সিন্ধু পানিচুক্তি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পানি বণ্টনের একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী, সিন্ধু অববাহিকার ছয়টি নদীর পানি দুই দেশের মধ্যে ভাগ করা হয়। পূর্বাঞ্চলের রাভি, বিয়াস ও শতদ্রু নদী ভারতের নিয়ন্ত্রণে এবং পশ্চিমাঞ্চলের সিন্ধু, জেলাম ও চেনাব নদী প্রধানত পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ। তবে, ভারতকে পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীগুলোর পানি সীমিত পরিসরে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যদি তারা পাকিস্তানের সঙ্গে তথ্য ভাগাভাগি করে।
৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই চুক্তি যুদ্ধ, সংঘাত ও কূটনৈতিক সংকটের মধ্যেও টিকে ছিল। কিন্তু ভারতের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত এই চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। পাকিস্তান অভিযোগ করেছে, ভারত চেনাব নদীর পানিপ্রবাহ কমিয়ে দিয়েছে, যা পাকিস্তানের কৃষি ও জনজীবনের জন্য মারাত্মক হুমকি। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ভারতের এই পদক্ষেপ চুক্তির “প্রক্রিয়াগত এবং সহযোগিতামূলক কাঠামো” লঙ্ঘন করেছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, পানিকে “অস্ত্র” হিসেবে ব্যবহার করা উভয় দেশের জন্যই বিপজ্জনক হতে পারে। পাকিস্তানের পাঞ্জাব ও সিন্ধ প্রদেশের কৃষি এই নদীগুলোর পানির ওপর নির্ভরশীল। পানিপ্রবাহে কোনো পরিবর্তন এই অঞ্চলে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। অপরদিকে, ভারতের বাঁধগুলো সীমান্ত থেকে অনেক দূরে অবস্থিত হওয়ায় হঠাৎ পানি ছাড়লে ভারতের নিজস্ব এলাকাও প্লাবনের ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
জাতিসংঘে পাকিস্তানের কৌশল
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার জাতিসংঘে দেশটির স্থায়ী প্রতিনিধি আসিম ইফতিখারকে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক আহ্বানের জন্য অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। পাকিস্তান জানিয়েছে, তারা জাতিসংঘে ভারতের “আগ্রাসী কর্মকাণ্ড” এবং “উসকানিমূলক বক্তব্য” নিয়ে বিস্তারিত অভিযোগ তুলবে। বিশেষ করে, সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত করার বিষয়টিকে তারা “বেআইনি” হিসেবে উপস্থাপন করবে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরার জন্য পাকিস্তানের প্রচেষ্টার অংশ।” পাকিস্তান আন্তর্জাতিক আদালতে এই ইস্যুতে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তুতিও নিচ্ছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ইতিমধ্যে এই উত্তেজনা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি ভারত ও পাকিস্তানের নেতাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে সংযম প্রদর্শন এবং শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন। জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টিফান ডুজারিক জানিয়েছেন, মহাসচিব উত্তেজনা হ্রাসে সহায়তার জন্য তার “সৌজন্যমূলক সেবা” প্রদানের প্রস্তাব দিয়েছেন।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়া
পাকিস্তান সরকার এই সংকট মোকাবিলায় সর্বদলীয় বৈঠক আহ্বান করেছে, যেখানে তথ্যমন্ত্রী ও সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র দেশটির শীর্ষ নেতাদের ব্রিফ করবেন। তবে, ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) এই বৈঠকে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিভেদকে প্রকাশ করে।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীও উচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ ভারতের যেকোনো “দুঃসাহসিক” পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কঠোর জবাব দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা
এই সংকটে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীন, পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে, জাতিসংঘে পাকিস্তানের অবস্থানকে সমর্থন করেছে। একটি পোস্টে দাবি করা হয়েছে, চীনের সহায়তায় পাকিস্তান নিরাপত্তা পরিষদে পেহেলগাম হামলার নিন্দা প্রস্তাবে ভারতের অভিযোগ অন্তর্ভুক্ত করতে বাধা দিয়েছে। তবে, এই তথ্যের সত্যতা স্বাধীনভাবে যাচাই করা যায়নি।
অন্যদিকে, ভারত জাতিসংঘে তার অবস্থানকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স ভারতকে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ দেওয়ার পক্ষে সমর্থন জানিয়েছে। এই সমর্থন ভারতের কূটনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি করলেও, পাকিস্তানের অভিযোগগুলো নিরাপত্তা পরিষদে গুরুত্ব পাবে কিনা, তা এখনও অনিশ্চিত।
সম্ভাব্য পরিণতি
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এই উত্তেজনা যদি নিয়ন্ত্রণে না আসে, তবে তা দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। দুই দেশই পারমাণবিক শক্তিধর, এবং যেকোনো সামরিক সংঘাত মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। সিন্ধু পানিচুক্তির স্থগিতকরণ পাকিস্তানের অর্থনীতি ও কৃষি খাতের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে, যা দেশটির অভ্যন্তরীণ অস্থিরতাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, জাতিসংঘের মধ্যস্থতা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ এই সংকট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে, উভয় দেশের কঠোর অবস্থান এবং পারস্পরিক অবিশ্বাস শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে বড় চ্যালেঞ্জ।