প্রযুক্তি

যুক্তরাষ্ট্রে চালু হলো চালকবিহীন ট্রাক, একটানা পার করল ১২০০ মাইল

যুক্তরাষ্ট্রে প্রযুক্তির জগতে আরেকটি নতুন মাইলফলক যুক্ত হলো। এবার আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হলো চালকবিহীন ট্রাকের বাণিজ্যিক পরিষেবা। পরীক্ষামূলক যাত্রা পেরিয়ে, এবার নিয়মিত বাণিজ্যিক পণ্য পরিবহনে ব্যবহার হচ্ছে এসব স্বচালিত ট্রাক। টেক্সাসের ডালাস থেকে হিউস্টনের মধ্যে চলাচলকারী এই ট্রাকগুলো ইতোমধ্যে ১২০০ মাইল দূরত্ব পাড়ি দিয়েছে কোনও মানব চালক ছাড়াই।

এই যুগান্তকারী পরিষেবা চালু করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্বচালিত প্রযুক্তি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান অরোরা ইনোভেশন। প্রতিষ্ঠানটি তাদের প্রথম বাণিজ্যিক গ্রাহক হিসেবে যুক্ত হয়েছে উবার ফ্রেইট ও হার্শবাক মোটর লাইনসের সঙ্গে। মূলত সময় ও তাপমাত্রা সংবেদনশীল পণ্য পরিবহনের জন্য তারা এই স্বচালিত ট্রাক সেবা গ্রহণ করছে।

চার বছরের প্রস্তুতি শেষে বড় পদক্ষেপ

অরোরা গত চার বছর ধরে পরীক্ষামূলকভাবে এই স্বচালিত ট্রাক পরিচালনা করছিল। এসময়ে ‘অরোরা ড্রাইভার’ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ১০ হাজারের বেশি পণ্য নিরাপদে সরবরাহ করা হয়েছে। যদিও তখন প্রতিটি ট্রাকেই একজন নিরাপত্তা চালক উপস্থিত থাকতেন। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার (১ মে) শুরু হওয়া নতুন পরিষেবায় ট্রাকগুলোর ভেতরে আর কোনো চালক নেই। পুরোপুরি স্বচালিত এই ট্রাক এখন চলাচল করছে খোলা সড়কে, নিয়মিত বাণিজ্যিক পরিষেবার অংশ হিসেবে।

অরোরা জানায়, তাদের প্রযুক্তি চারটি ফুটবল মাঠের সমান দূরত্ব আগেভাগে শনাক্ত করতে পারে। ট্রাকগুলোতে ব্যবহার করা হয়েছে উন্নতমানের কম্পিউটার, সেন্সর ও ক্যামেরা সিস্টেম, যা চলার পথে প্রতিটি পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম।

নিরাপদ, দ্রুত ও বাস্তবসম্মত’— দাবি প্রতিষ্ঠাতার

অরোরা ইনোভেশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সিইও ক্রিস উর্মসন বলেন, “আমরা অরোরা প্রতিষ্ঠা করেছি এমন একটি লক্ষ্য নিয়ে, যাতে স্বচালিত প্রযুক্তির সুবিধা নিরাপদে, দ্রুত ও বৃহৎ পরিসরে পৌঁছে দেওয়া যায়। আজ আমরা সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে সফল হয়েছি। আমরাই প্রথম, যারা চালক ছাড়া ট্রাক চালিয়ে বাণিজ্যিক পণ্য পরিবহন শুরু করলাম।”

তিনি আরও জানান, বর্তমানে এই পরিষেবাটি একটি ট্রাক দিয়ে চালু করা হলেও ২০২৫ সালের মধ্যে ধাপে ধাপে আরও অনেক ট্রাক যুক্ত করা হবে। ভবিষ্যতে এই পরিষেবাকে অন্যান্য রাজ্যেও সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।

নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও প্রযুক্তির ওপর আস্থা বাড়ছে

স্বচালিত যানবাহন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনও নিরাপত্তা সংক্রান্ত কিছু উদ্বেগ রয়েছে। বিশেষ করে দুর্ঘটনার আশঙ্কা, হ্যাকিং বা যান্ত্রিক ত্রুটির মতো শঙ্কা মানুষের মনে কাজ করে। অরোরা এই উদ্বেগ প্রশমনের জন্য এবছর একটি বিস্তারিত নিরাপত্তা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে প্রযুক্তির কার্যপ্রণালী, ঝুঁকি নিরসনের উপায় এবং সড়কে ব্যবহারের নিরাপত্তা বিষয়ক তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

প্রতিবেদনে দেখানো হয়, কীভাবে ট্রাকের সেন্সর ও সফটওয়্যার মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, হঠাৎ কোনো যানবাহন বা মানুষ সামনে এলে কীভাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্রেক নেয় বা পথ পরিবর্তন করে, এবং প্রতিকূল আবহাওয়ায় কীভাবে প্রযুক্তি কাজ করে।

শ্রমিক ইউনিয়নের আপত্তি: ‘চাকরি হারাবে হাজারো মানুষ’

যদিও এই প্রযুক্তিকে অগ্রগতির নিদর্শন হিসেবে দেখা হচ্ছে, তবে ট্রাক চালকদের সংগঠনগুলো এতে উদ্বিগ্ন। তাদের মতে, এ ধরনের স্বচালিত ট্রাক ভবিষ্যতে চালকদের কাজ কেড়ে নেবে, ফলে ব্যাপক হারে চাকরি হারানোর আশঙ্কা তৈরি হবে। এ ছাড়া দুর্ঘটনার দায় কার ওপর বর্তাবে, সে প্রশ্নও তোলা হচ্ছে।

ট্রাকচালকদের শ্রমিক ইউনিয়নগুলো বলছে, “স্বচালিত ট্রাক যদি পুরো ইন্ডাস্ট্রিতে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে লাখ লাখ ট্রাকচালক তাদের জীবিকা হারাবে। শুধু তাই নয়, মানবিক বোধ বা তাৎক্ষণিক সতর্কতার অভাব থেকে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়তে পারে।”

তবে অরোরা বলছে, তারা আপাতত পণ্য পরিবহনের নির্দিষ্ট রুটেই এই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে এবং কাজের সুযোগ হারানো রোধে তাদের পক্ষ থেকে পুনঃপ্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

বাণিজ্যিক পরিবহনে প্রযুক্তির বিপ্লব

বিশ্বজুড়ে পণ্য পরিবহন খাতে স্বচালিত প্রযুক্তির সম্ভাবনা অনেক আগে থেকেই আলোচনায়। কিন্তু বাস্তবিকভাবে তা সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হলো যুক্তরাষ্ট্র। চালকবিহীন ট্রাক শুধুই সময় বাঁচাবে না, দীর্ঘপথে চালকদের ক্লান্তি, দুর্ঘটনার ঝুঁকি ও খরচও কমাবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি আরও উন্নত হবে এবং এর বিস্তার ঘটবে বিশ্বব্যাপী। ট্রাক ছাড়াও ট্যাক্সি, বাস এমনকি ফ্রেইট ট্রেনেও স্বচালিত প্রযুক্তি চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশের জন্য কী বার্তা?

যুক্তরাষ্ট্রে চালকবিহীন ট্রাক চালুর ঘটনা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য বড় এক শিক্ষা হতে পারে। যদিও এখনই এই প্রযুক্তি আমদানির বাস্তবতা নেই, তবুও ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি। ডিজিটাল রোড নেটওয়ার্ক, ট্রাফিক সিগন্যালিং এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সহায়তায় অদূর ভবিষ্যতে এমন প্রযুক্তির ব্যবহারের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন থেকেই বাংলাদেশকে চালকদের দক্ষতা উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত শিক্ষা এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়নের দিকে নজর দিতে হবে। তাহলে ভবিষ্যতের গ্লোবাল ট্রান্সপোর্টেশন রেভল্যুশনের অংশ হতে পারবে দেশ।

যুক্তরাষ্ট্রে ১২০০ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে সফলভাবে বাণিজ্যিকভাবে চালকবিহীন ট্রাক চলাচলের ঘটনা নিঃসন্দেহে ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। প্রযুক্তি যে শুধু কল্পনার বিষয় নয়, বাস্তব জীবনে তা কতটা কার্যকর, সেটিই প্রমাণ করল অরোরা। এখন দেখার বিষয়, কত দ্রুত ও কত নিরাপদভাবে এই প্রযুক্তি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এবং মানবসভ্যতার পণ্য পরিবহন খাতকে কতটা বদলে দেয়।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button