বানিজ্য

হালাল পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশের নতুন দিগন্ত: পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তির সম্ভাবনা

বাংলাদেশের জন্য বৈদেশিক বাজারে হালাল পণ্যের রপ্তানিতে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলছে। পাকিস্তানের সঙ্গে একটি আলোচিত সমঝোতা স্মারক (MoU) চুক্তির মাধ্যমে হালাল পণ্য রপ্তানি সহজ হতে যাচ্ছে, যা দেশের বৈদেশিক আয় বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই চুক্তি শুধু বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যকার বাণিজ্যিক সম্পর্ককেই দৃঢ় করবে না, বরং বাংলাদেশকে বৈশ্বিক হালাল পণ্যের বাজারে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে যাবে। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে হালাল পণ্যের চাহিদা দ্রুতগতিতে বাড়ছে, আর সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ বিশাল রপ্তানি আয় নিশ্চিত করতে পারবে।

বিশ্বব্যাপী হালাল পণ্যের বিশাল বাজার

বর্তমানে হালাল পণ্যের বাজার শুধু মুসলিম দেশেই সীমাবদ্ধ নয়। ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়াতেও হালাল পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। গবেষণা অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী হালাল পণ্যের বাজার ছিল প্রায় ৪.৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, এবং প্রতি বছর এ বাজার ২০ শতাংশ হারে বাড়ছে। আশা করা হচ্ছে, ২০২৫ সালের মধ্যে এই বাজারের আকার পৌঁছাবে ৬ ট্রিলিয়ন ডলারে।

খাদ্যপণ্য ছাড়াও স্বাস্থ্যসেবা, কসমেটিকস, ফ্যাশন ও ফার্মাসিউটিক্যাল খাতে হালাল পণ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বিশ্বের ৫৭টি মুসলিম প্রধান দেশসহ অ-মুসলিম দেশেও হালাল পণ্য এখন এক গুরুত্বপূর্ণ ট্রেড মার্ক হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশ-পাকিস্তান হালাল চুক্তির উদ্যোগ

পাকিস্তানের হালাল অথরিটি সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা বিএসটিআই এবং দেশের বৃহৎ ব্যবসায়ী সংগঠন এফবিসিসিআই-এর মাধ্যমে একটি খসড়া সমঝোতা চুক্তি পাঠিয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রস্তাবটি বিএসটিআইতে পৌঁছায় এবং বর্তমানে তা মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।

বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) মহাপরিচালক এস এম ফেরদৌস আলম জানান, “চুক্তির খসড়া আমাদের হাতে এসেছে। এখন আমরা বিভিন্ন শর্ত ও মানদণ্ড পর্যালোচনা করে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনায় যাচ্ছি। এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে দুই দেশের হালাল পণ্যের বাণিজ্যে এক নতুন দিগন্তের সূচনা হবে।”

হালাল সার্টিফিকেশন প্রযুক্তি: বাংলাদেশের জন্য অগ্রগতির পথ

বর্তমানে বিএসটিআই আন্তর্জাতিক ইসলামী সংস্থা ওআইসি (OIC)-এর মান অনুযায়ী ১৬১টি পণ্যের হালাল সনদ দিচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে চাল, সাদা চিনি, দুগ্ধজাত পণ্য, বেকারি আইটেম, মাছ, মাংস, মিষ্টান্ন এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য।

পাকিস্তানের সঙ্গে চুক্তি হলে সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তিগত উন্নয়ন হবে। উভয় দেশ তথ্য ও প্রযুক্তি আদান-প্রদান করবে এবং একে অপরের সার্টিফিকেটকে স্বীকৃতি দেবে। এর ফলে বাংলাদেশের পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে আরও দ্রুত ও সহজে প্রবেশ করতে পারবে।

এফবিসিসিআই-এর ভূমিকা ও বিশ্লেষণ

বাংলাদেশের এফবিসিসিআই প্রশাসক ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব হাফিজুর রহমান বলেন, “এই চুক্তি হবে একটি মাইলফলক। হালাল পণ্য রপ্তানিতে আমাদের অনেক বাধা ছিল, বিশেষ করে সার্টিফিকেশন ও মান নিয়ন্ত্রণে। এখন যদি দুই দেশ একে অপরের মানদণ্ড স্বীকার করে, তাহলে বাংলাদেশের রপ্তানি বহুগুণে বাড়বে।”

তিনি আরও বলেন, “এই সমঝোতা বাংলাদেশকে শুধু পাকিস্তানের বাজারেই নয়, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাজারেও প্রবেশে সহায়ক হবে।”

আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের হালাল পণ্যের সম্ভাবনা

বিশ্বের বৃহত্তম হালাল পণ্যের বাজার বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মতো দেশে হালাল পণ্যের অভাবনীয় চাহিদা রয়েছে।

বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি ও মৎস্য শিল্পকে কাজে লাগিয়ে হালাল খাদ্যপণ্য উৎপাদনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। উন্নত প্রক্রিয়াকরণ ও আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করতে পারলে এই বাজারে বাংলাদেশ একটি বড় নাম হতে পারে।

রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

বিএসটিআই সূত্রে জানা গেছে, ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২০ কোটি মার্কিন ডলারের হালাল পণ্য রপ্তানির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এই লক্ষ্যমাত্রা আগামী পাঁচ বছরে ৪০ কোটিতে উন্নীত করা সম্ভব বলে আশা করা হচ্ছে।

সরকার ইতোমধ্যে কৃষকদের হালাল উৎপাদন পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এবং হালাল শিল্পে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াচ্ছে। একইসাথে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘হালাল ইন্ডাস্ট্রি ম্যানেজমেন্ট’ নিয়ে কোর্স চালুর কথাও ভাবা হচ্ছে।

চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

তবে হালাল পণ্যের বিশ্ববাজারে প্রবেশে বাংলাদেশকে কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। যেমন:

  • আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী মান নির্ধারণ ও মান বজায় রাখা
  • আধুনিক গবেষণাগার ও ল্যাব স্থাপন
  • হালাল রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ
  • আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় জোরদার করা

এই চ্যালেঞ্জগুলো সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারলে হালাল পণ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আগামীতে বিশ্ববাজারে এক বিশাল শক্তি হয়ে উঠতে পারে।

বিশ্বব্যাপী হালাল পণ্যের বাজারে বাংলাদেশের প্রবেশ এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। পাকিস্তানের সঙ্গে প্রস্তাবিত সমঝোতা চুক্তি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের হালাল রপ্তানি খাতে এক নতুন ইতিহাস রচিত হবে।

সরকার, ব্যবসায়িক সংগঠন ও রপ্তানিকারকদের সমন্বিত প্রচেষ্টায় হালাল পণ্য হতে পারে বাংলাদেশের পরবর্তী বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের বড় উৎস।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button