প্রযুক্তি

লাইসেন্স পেলো স্টারলিংক: স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের নতুন দিগন্ত

বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতির জন্য এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে, মার্কিন ধনকুবের ইলন মাস্কের স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান স্টারলিংক দেশে ব্যবসা পরিচালনার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে লাইসেন্স লাভ করেছে। সোমবার (২৮ এপ্রিল) প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই লাইসেন্সের অনুমোদন দেন। শ্রীলঙ্কার পর দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশে এই বৈশ্বিক স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা প্রবেশ করল, যা দেশের টেলিযোগাযোগ খাতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে।

স্টারলিংকের লাইসেন্স প্রাপ্তির পটভূমি

স্টারলিংকের বাংলাদেশে প্রবেশের পেছনে রয়েছে দেশের ডিজিটাল সংযোগ এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষ্য। গত জুলাইয়ে গণঅভ্যুত্থানের সময় তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকারের ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধের ঘটনা জনমনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এই ঘটনার প্রতিবাদে স্টারলিংকের মতো বিকল্প ইন্টারনেট সেবা প্রবর্তনের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব এ প্রসঙ্গে বলেন, “গণঅভ্যুত্থানের সময় ইন্টারনেট বন্ধের ঘটনা স্টারলিংককে বাংলাদেশে নিয়ে আসার জন্য জনগণের একটি বড় দাবিতে রূপ নিয়েছিল। এছাড়া, বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে বিনিয়োগবান্ধব দেশ হিসেবে উপস্থাপন করার একটি সুযোগ হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।”

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) গত ২৫ মার্চ ‘নন-জিওস্টেশনারি অরবিট (এনজিএসও) স্যাটেলাইট সার্ভিসেস অপারেটর ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক লাইসেন্সিং নির্দেশিকা জারি করে। এই নির্দেশিকার আলোকে স্টারলিংক বিটিআরসির কাছে লাইসেন্সের জন্য আবেদন করে। গত ২১ এপ্রিল কমিশনের সভায় স্টারলিংককে লাইসেন্স প্রদানের নীতিগত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, যা আজ আনুষ্ঠানিকভাবে বাস্তবায়িত হলো।

স্টারলিংকের সেবা এবং এর প্রভাব

স্টারলিংক হলো স্পেসএক্সের একটি উদ্যোগ, যা নিম্ন কক্ষপথে (লো আর্থ অরবিট) অবস্থিত হাজার হাজার ক্ষুদ্র স্যাটেলাইটের মাধ্যমে উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা প্রদান করে। এই প্রযুক্তি প্রথাগত ফাইবার অপটিক বা মোবাইল নেটওয়ার্কের তুলনায় অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য এবং দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান করতে সক্ষম। বিশেষ করে গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যেখানে ঐতিহ্যবাহী ইন্টারনেট পরিষেবা পৌঁছায় না, সেখানে স্টারলিংক বিপ্লব ঘটাতে পারে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্টারলিংকের প্রবেশ ডিজিটাল বিভাজন কমিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। দেশের প্রায় ৬৮ শতাংশ মানুষ গ্রামাঞ্চলে বাস করে, যেখানে ইন্টারনেট সংযোগ এখনও সীমিত। স্টারলিংকের স্যাটেলাইটভিত্তিক সেবা এই অঞ্চলগুলোতে সাশ্রয়ী এবং নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট সরবরাহ করতে পারে। এছাড়া, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, এবং কৃষি খাতে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে, যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখবে।

অর্থনৈতিক ও বিনিয়োগের সম্ভাবনা

স্টারলিংকের বাংলাদেশে প্রবেশ শুধু টেলিযোগাযোগ খাতের জন্যই নয়, সামগ্রিক অর্থনীতির জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই উদ্যোগ বাংলাদেশকে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তুলবে। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, স্টারলিংকের মতো বৈশ্বিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি দেশের ব্যবসায়িক পরিবেশ সম্পর্কে ইতিবাচক বার্তা প্রেরণ করবে। এছাড়া, স্টারলিংকের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য স্থানীয় জনবল নিয়োগ এবং প্রযুক্তিগত অবকাঠামো স্থাপনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

তবে, স্টারলিংকের সেবার মূল্য নির্ধারণ এবং এর সাশ্রয়ীতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। বৈশ্বিক বাজারে স্টারলিংকের সেবা তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল, যা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে। বিটিআরসি এবং স্টারলিংকের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে স্থানীয় বাজারের জন্য সাশ্রয়ী মূল্য নির্ধারণের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হবে।

চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

স্টারলিংকের বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু হলেও, বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। প্রথমত, স্যাটেলাইট ইন্টারনেট পরিষেবার জন্য প্রয়োজনীয় ডিশ এবং রিসিভার স্থাপনের ব্যয় বাংলাদেশের গ্রাহকদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা এবং নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি প্রণয়নের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। বিটিআরসি এই বিষয়ে সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে সকল পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে।

ভবিষ্যতে স্টারলিংক বাংলাদেশে তার সেবার পরিধি বাড়াতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, এবং সরকারি দপ্তরে স্টারলিংকের ইন্টারনেট সেবা প্রবর্তন করা যেতে পারে। এছাড়া, বাংলাদেশের উপকূলীয় এবং দুর্গম অঞ্চলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য স্টারলিংকের নির্ভরযোগ্য সংযোগ ব্যবহার করা যেতে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button