বিশ্ব

কাশ্মীরে উত্তেজনা: ভারত-পাকিস্তানকে সংযমের আহ্বান জানালো চীন

কাশ্মীরে ফের উত্তপ্ত পরিস্থিতি। ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন প্রাণ হারানোর পর দু’দেশের মধ্যে আবারও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। হামলার জন্য সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করেছে ভারত। পাল্টা জবাবে পাকিস্তানও নানা ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এরই মধ্যে লাইন অফ কন্ট্রোলে (LOC) গোলাগুলি চলছে টানা চারদিন ধরে। উদ্বেগজনক এ পরিস্থিতিতে ভারত ও পাকিস্তানকে সর্বোচ্চ সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়েছে চীন।

কী ঘটেছে জম্মু ও কাশ্মীরে?

গত সপ্তাহে পেহেলগামে ভয়াবহ হামলার ঘটনা ঘটে, যেখানে অন্তত ২৬ জন নিহত হয়েছেন। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে দায়ী করেছে এবং বিষয়টিকে ‘সর্বোচ্চ নিন্দনীয়’ বলে অভিহিত করেছে। এরপর থেকেই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়। ভারতের পক্ষ থেকে একাধিক কূটনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, যার প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানও পাল্টা ঘোষণা দেয়।

এদিকে জম্মু ও কাশ্মীরের পুঞ্চ ও কুপওয়ারা জেলায় সীমান্তের লাইন অফ কন্ট্রোলে টানা চতুর্থ রাত গোলাবিনিময় হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, রাতভর গোলাগুলির শব্দে তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।

ভারতীয় সেনাবাহিনী দাবি করেছে, পাকিস্তানি সেনারা ‘অপ্ররোচিতভাবে’ গুলি চালিয়েছে। তবে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য আসেনি।

চীনের শান্তি বজায় রাখার আহ্বান

এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মহলও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সোমবার (২৮ এপ্রিল) স্থানীয় সময় বেইজিংয়ে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গুও জিয়াকুন বলেন,

“আমরা ভারত ও পাকিস্তানকে সর্বোচ্চ সংযম দেখানোর এবং আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে যৌথভাবে কাজ করার আহ্বান জানাই।”

তিনি আরও জানান, চীন এমন সব পদক্ষেপকে স্বাগত জানায়, যা পরিস্থিতি শান্ত করতে সহায়ক হবে।

চীনের এই আহ্বান প্রমাণ করে যে, দক্ষিণ এশিয়ায় যুদ্ধ বা সংঘর্ষ এড়িয়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে বিশ্বশক্তিগুলোরও সুস্পষ্ট আগ্রহ রয়েছে। বিশেষ করে চীন, যে কিনা পাকিস্তানের দীর্ঘমেয়াদী মিত্র এবং ভারতের অন্যতম বৃহৎ প্রতিবেশী।

ভারতের সামরিক প্রস্তুতি ও কূটনৈতিক পদক্ষেপ

হামলার পর থেকে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী সারাদেশে একাধিক সামরিক মহড়া শুরু করেছে। যদিও ভারতীয় কর্মকর্তারা বলেছেন, এগুলো “স্বাভাবিক প্রস্তুতিমূলক অনুশীলন”, তবে বিশ্লেষকদের মতে, এগুলো মূলত পাকিস্তানের ওপর চাপ প্রয়োগের কৌশল।

রয়টার্সের বরাত দিয়ে এক ভারতীয় প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেন, এই মহড়াগুলো “প্রতিরোধমূলক শক্তি প্রদর্শন” হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যার মাধ্যমে ভারতের জনগণের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বজায় রাখা হচ্ছে এবং পাকিস্তানকে সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার জন্য সতর্ক করা হচ্ছে।

দুই দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ

কাশ্মীর হামলার পর উভয় দেশই পরস্পরের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ, কূটনৈতিক সম্পর্ক হ্রাস এবং সীমান্তে সেনা মোতায়েন বৃদ্ধির মতো একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, এই উত্তেজনা এখনো “নিয়ন্ত্রিত” পর্যায়ে থাকলেও তা খুব দ্রুতই “পূর্ণমাত্রার সংঘাতে” রূপ নিতে পারে। কারণ, ভারত ও পাকিস্তান দু’দেশেরই পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে, যা পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলতে পারে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের একাধিক দেশ ভারত ও পাকিস্তানকে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিবের কার্যালয় থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “সংঘাত প্রশমন এবং শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের জন্য দু’পক্ষকেই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।”

যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টও বলেছে, দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে দুই দেশের সংযত আচরণ জরুরি।

বিশ্লেষকরা কী বলছেন?

বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক এমনিতেই গভীর অবিশ্বাসের স্তরে দাঁড়িয়ে আছে। কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে অতীতে বহুবার রক্তক্ষয়ী সংঘাত হয়েছে। তাই এখনকার এই উত্তেজনা কোনোভাবে যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তবে তা শুধু দুই দেশের জন্য নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য মারাত্মক নিরাপত্তা হুমকি তৈরি করবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে ভারতের ভেতরে জাতীয়তাবাদী আবেগ উস্কে উঠেছে, আর পাকিস্তানও অভ্যন্তরীণ চাপের মুখে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে উভয়পক্ষের জন্য শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ খোঁজা সহজ হবে না।

কাশ্মীরে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলা এবং তার পরবর্তী ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা গোটা অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে চরম ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। যদিও চীনসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানাচ্ছে, বাস্তবে দুই দেশের পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং কাশ্মীর নিয়ে দীর্ঘদিনের টানাপোড়েন নতুন করে সংঘাতের আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলেছে।

বিশেষ করে পারমাণবিক শক্তিধর এই দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাধলে তার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। তাই সংযম ও কূটনৈতিক সংলাপের কোনো বিকল্প নেই।

বিশ্ববাসী এখন তাকিয়ে আছে—দেখার জন্য ভারত ও পাকিস্তান কীভাবে এই সংকট সামাল দেয়।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button