বিশ্ব

ট্রাম্পকে হত্যার জন্য অর্থ সংগ্রহে বাবা-মাকে খুন

যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যে ১৭ বছর বয়সী এক কিশোর তার বাবা–মাকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেছে। কারণ? সে চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হত্যার জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি ফেডারেল ওয়ারেন্টে উঠে এসেছে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য।

এই কিশোরের নাম নিকিতা ক্যাসাপ। তার বিরুদ্ধে শুধু পারিবারিক হত্যাকাণ্ড নয়, বরং মার্কিন সরকারের পতন ঘটানোর ষড়যন্ত্র, রাষ্ট্রপতি হত্যা পরিকল্পনা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগীদের সঙ্গে যোগাযোগের অভিযোগও রয়েছে।

দুই সপ্তাহ মৃতদেহের পাশে অবস্থান

অভিযোগে বলা হয়, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে উইসকনসিনের মিলওয়াকির উপকণ্ঠে নিজেদের বাড়িতে মা তাতিয়ানা ক্যাসাপ (৩৫) এবং সৎ বাবা ডোনাল্ড মেয়ার (৫১)-কে গুলি করে হত্যা করে নিকিতা। এরপর প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে মৃতদেহের সঙ্গে একই বাড়িতে অবস্থান করে সে।

নির্মম এই হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার করা হয় আগ্নেয়াস্ত্র। এরপর নিকিতা ১৪ হাজার ডলার নগদ অর্থ, পাসপোর্ট এবং তাদের পোষা কুকুর নিয়ে পালিয়ে যায়। কর্তৃপক্ষ ধারণা করছে, সে পরিকল্পিতভাবেই এই কাজ করেছে অর্থ সংগ্রহের জন্য, যাতে করে সে নিজস্ব রাজনৈতিক লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে পারে।

গ্রেপ্তার ও আদালতে হাজিরা

দীর্ঘ তদন্ত শেষে মার্চ মাসে কানসাস রাজ্যে নিকিতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তখন তার সঙ্গে ছিল বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ, গাড়ি, পাসপোর্ট এবং কুকুরটি। বর্তমানে সে ওয়াউকেশা কাউন্টি জেলে ১০ লাখ ডলারের বন্ডে আটক রয়েছে। আগামী মাসে তাকে আবার আদালতে হাজির করা হবে।

ফেডারেল তদন্তে উন্মোচিত হয় হত্যার মূল উদ্দেশ্য

প্রথমে মনে করা হয়েছিল, এটি শুধুই পারিবারিক সহিংসতা। তবে ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (FBI) ও যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তদন্তে বেরিয়ে আসে এক ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা।
১২ এপ্রিল প্রকাশিত একটি ফেডারেল ওয়ারেন্টে নিকিতা ক্যাসাপের উদ্দেশ্য বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

ওই ওয়ারেন্টে বলা হয়েছে,

  • ক্যাসাপ ট্রাম্পকে হত্যার আহ্বান জানিয়ে একটি ইহুদি-বিদ্বেষী ইশতেহার লিখেছিল
  • ইশতেহারটি ছিল তিন পৃষ্ঠার, যেখানে অ্যাডলফ হিটলারের প্রশংসা করা হয়েছে
  • ইন্টারনেটে সে টেলিগ্রাম ও টিকটক-এর মাধ্যমে অপরিচিত ব্যক্তিদের সঙ্গে এসব পরিকল্পনা শেয়ার করেছিল
  • সে রুশ ভাষাভাষী এক ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগে ছিল এবং ইউক্রেনে পালানোর পরিকল্পনা করছিল

ফেডারেল প্রসিকিউটররা বলছেন, নিকিতা সরকার উৎখাতের উদ্দেশ্যে ট্রাম্প এবং সম্ভবত ভাইস প্রেসিডেন্টকেও হত্যা করতে চেয়েছিল। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অর্থ সংগ্রহের একমাত্র পথ হিসেবে সে বেছে নেয় বাবা-মাকে খুন করার পন্থা।

অনলাইন চ্যাট, ড্রোন ও বিস্ফোরক কেনার পরিকল্পনা

ওয়ারেন্টে আরও বলা হয়েছে, ক্যাসাপ ড্রোন ও বিস্ফোরক কেনার চেষ্টাও করছিল। টেলিগ্রাম মেসেঞ্জার এবং TikTok-এ তার একাধিক চ্যাট পাওয়া গেছে, যেখানে সে বলেছে— “আমার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে অর্থ দরকার, আর সে জন্যই বাবা-মাকে সরাতে হয়েছে।”

FBI বলছে, নিকিতা অনলাইনে সন্ত্রাসবাদের মতো চিন্তাধারার প্রশংসা করছিল এবং ট্রাম্পকে ‘সরিয়ে দেওয়া’র প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরছিল। এমনকি সে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাঠামো ভেঙে ফেলার কথা বলেছিল।

পরিবারের লাশ খুঁজে পাওয়া ও তদন্ত শুরু

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি, নিকিতা ক্যাসাপ ও তার মা-বাবার খোঁজ না পেয়ে পরিবারের অন্য সদস্যরা পুলিশে অভিযোগ করেন। স্কুল কর্তৃপক্ষও জানায়, সে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে স্কুলে অনুপস্থিত। পরে পুলিশ বাড়িতে গিয়ে দেখতে পায়, ঘরের মধ্যে দুটি পচাগলা লাশ পড়ে আছে।

দাঁতের রেকর্ডের মাধ্যমে শনাক্ত করা হয়— এগুলো তাতিয়ানা ও মেয়ার-এর মৃতদেহ। বাড়িতে ছড়িয়ে ছিল রক্ত, বন্দুক, এবং হত্যার আলামত।

নিকিতা ক্যাসাপ কে?

নিকিতা ক্যাসাপের সম্পর্কে এখনও বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেনি কর্তৃপক্ষ। তবে জানা গেছে, সে উচ্চমেধাসম্পন্ন একজন ছাত্র ছিল, যার আচরণ আচমকা বদলে গিয়েছিল। কিছু প্রতিবেশী জানিয়েছে, সে বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তাধারায় বিশ্বাসী ছিল এবং একাকী চলাফেরা করত।

তার স্কুলের এক শিক্ষক জানান, “নিকিতা সবসময় ইতিহাস ও রাজনীতির প্রতি আগ্রহ দেখাতো। কিন্তু গত ছয় মাসে তার আচরণে পরিবর্তন এসেছিল। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও নাৎসি দর্শনের প্রতি তার বাড়তি আগ্রহ লক্ষ্য করি।”

আইনজীবীর নীরবতা

নিকিতার আইনজীবী নিকোল ওস্ট্রোভস্কি-এর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম। তবে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।

ভবিষ্যৎ বিচার ও ফেডারেল অভিযোগ

ফেডারেল প্রসিকিউটররা বলছেন, শুধুমাত্র পারিবারিক হত্যা নয়, নিকিতা ক্যাসাপের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র, সন্ত্রাসবাদে প্ররোচনা, এবং রাষ্ট্রপতি হত্যা পরিকল্পনার অভিযোগও আনা হতে পারে। এসব অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে তার আজীবন কারাদণ্ডও হতে পারে।

এফবিআই এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, “এই ঘটনা দেখাচ্ছে কীভাবে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ছড়ানো উগ্রবাদ, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এবং ঘৃণার ভাষা একজন কিশোরকেও জঙ্গিবাদে অনুপ্রাণিত করতে পারে।”

উপসংহার: একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি থেকে জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি

নিকিতা ক্যাসাপের এই ঘটনা শুধু একটি পরিবারকেই ধ্বংস করেনি, বরং এটি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা ও তরুণদের অনলাইন চেতনার ভয়াবহ বিপদও সামনে নিয়ে এসেছে।

যেখানে একটি কিশোর রাষ্ট্রপতি হত্যা ও সরকার উৎখাতের মতো ভয়ঙ্কর পরিকল্পনায় জড়িত হয়ে পড়ে, সেখানে প্রশ্ন ওঠে— আমাদের সমাজ, শিক্ষা ও অনলাইন নিরাপত্তাব্যবস্থায় কোথায় ঘাটতি রয়ে গেছে?

এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করে, কেবল অস্ত্র নয়, ঘৃণা, ষড়যন্ত্র এবং উগ্র মতাদর্শই অনেক সময় বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button