অর্থনীতি

ভেষজ ছত্রাক কর্ডিসেপস: ভুটানের নতুন ‘রপ্তানি রত্ন’

৪.২৩ কোটি ডলারের রপ্তানি আয় শুধুই কর্ডিসেপস থেকে

থাইল্যান্ড, জাপান, নেপালসহ ১৭টি দেশে কৃষিপণ্য যাচ্ছে

কৃষিপণ্য রপ্তানি বাড়লেও বাণিজ্য ঘাটতি এখনো রয়ে গেছে

প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ হিমালয়ের ছোট দেশ ভুটান এখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে শক্ত অবস্থান নিচ্ছে একটি বিরল ভেষজ ছত্রাক—‘কর্ডিসেপস’ এর মাধ্যমে। নানা স্বাস্থ্য উপকারিতার জন্য বিখ্যাত এই ছত্রাকটি এখন ভুটানের প্রধান রপ্তানিপণ্য হয়ে উঠেছে।

বিশেষত থাইল্যান্ড, জাপান ও নেপালের মতো দেশগুলোতে এই ছত্রাকের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভুটানের কৃষি রপ্তানি আয়ের বড় একটি অংশই এখন কর্ডিসেপসনির্ভর

আন্তর্জাতিক বাজারে কর্ডিসেপসের চাহিদা তুঙ্গে

কর্ডিসেপস হলো এক ধরনের ভেষজ ছত্রাক, যা দীর্ঘদিন ধরে চীন, তিব্বত ও হিমালয় অঞ্চলে ঔষধি উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এটি রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো, শ্বাসকষ্ট নিরাময় এবং দেহের সামগ্রিক শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে বলে অনেকে মনে করেন।

এই বিরল ছত্রাকটির স্বাভাবিক প্রজনন প্রক্রিয়া কঠিন এবং সংগ্রহের প্রক্রিয়া শ্রমসাধ্য, ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে এর মূল্য অত্যন্ত বেশি

ভুটান সরকার প্রকাশিত ২০২৪ সালের বাণিজ্য পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শুধুমাত্র কর্ডিসেপস রপ্তানি করেই দেশটি আয় করেছে ৪.২৩ কোটি মার্কিন ডলার—যা একক কোনো কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি।

কৃষিপণ্য রপ্তানিতে এগিয়ে থাইল্যান্ড, জাপান

ভুটানের কৃষিপণ্য রপ্তানির প্রধান গন্তব্য এখন থাইল্যান্ড
২০২৪ সালে থাইল্যান্ডে ভুটানের কৃষিপণ্য রপ্তানি হয়েছে ৮৩.২১ মিলিয়ন নিউট্রাম, যা অন্যান্য ১৭টি দেশে কৃষিপণ্য রপ্তানির ৪২.৮২%।

এরপরই রয়েছে জাপান, যেখানে রপ্তানি হয়েছে ৩০.৪০ মিলিয়ন নিউট্রাম মূল্যের কৃষিপণ্য। জাপানে সবচেয়ে বেশি রপ্তানিকৃত চারটি পণ্যের মধ্যে রয়েছে—

  • কর্ডিসেপস
  • মাসুতাকে মাশরুম
  • বাজরা
  • প্রাকৃতিক মধু

নেপালে রপ্তানি হয়েছে মূলত ধূপকাঠি ও গ্রিন টি, যার পরিমাণ ১৫.০৪ টন এবং মূল্য ৩.২৭ মিলিয়ন নিউট্রাম

এক বছরে ১৩টি দেশে ২১ ধরনের কৃষিপণ্য রপ্তানি

ভুটান ২০২৪ সালে ১৩টি দেশে ৪৫টি রপ্তানিকারকের মাধ্যমে ২১ ধরনের প্রাথমিক কৃষিপণ্য রপ্তানি করেছে, যার মধ্যে কর্ডিসেপস ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

এই রপ্তানির মধ্যে কর্ডিসেপস ছাড়াও উল্লেখযোগ্য পণ্যগুলো ছিল—

  • মাসুতাকে মাশরুম
  • মসলা
  • সুপারি
  • হ্যাজেলনাট (বাদাম)

এছাড়া প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য হিসেবেও রপ্তানি হয়েছে—

  • আদা গুঁড়া
  • মরিচ গুঁড়া
  • নানা ধরনের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য

এই তিনটি প্রক্রিয়াজাত পণ্য থেকেই আয় হয়েছে ৬.৮২ মিলিয়ন নিউট্রাম, আর মোট রপ্তানিকৃত পরিমাণ ছিল ৮.৭৬ মেট্রিক টন

বাণিজ্য ঘাটতি এখনো চ্যালেঞ্জ

রপ্তানি খাতে আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি সত্ত্বেও ভুটানের সামগ্রিক বাণিজ্য ঘাটতি এখনো বড় এক চ্যালেঞ্জ

২০২৪ সালে ভারত ছাড়া অন্য সব দেশের সঙ্গে ভুটানের:

  • মোট রপ্তানি: ১২,০৫১ মিলিয়ন নিউট্রাম
  • মোট আমদানি: ১৯,৮৬১ মিলিয়ন নিউট্রাম
  • বাণিজ্য ঘাটতি: ৭,৮১০ মিলিয়ন নিউট্রাম

এই তথ্যই দেখায়, বাজার সম্প্রসারণরপ্তানি বৈচিত্র্যতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা কতটা বেশি।

কর্ডিসেপস: অর্থনীতি ও পরিবেশের মধ্যকার ভারসাম্য

ভুটানে কর্ডিসেপস সংগ্রহ মূলত উচ্চ হিমালয় অঞ্চলে নিয়ন্ত্রিতভাবে করা হয়, যাতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা পায়। সরকার বছরে নির্দিষ্ট সময়ের জন্যই সংগ্রহের অনুমতি দেয় এবং রপ্তানিকারকদের নিবন্ধন ও লাইসেন্সের আওতায় আনা হয়

এই প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবস্থাপনা না হলে এটি পরিবেশ ও দীর্ঘমেয়াদী রপ্তানি সম্ভাবনার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে

একদিকে স্বাস্থ্য উপকারিতাসম্পন্ন ও মূল্যবান পণ্য—অন্যদিকে ভুটানের পাহাড়ি অঞ্চলে স্বাভাবিকভাবে জন্মানো সম্পদ, এই ‘সোনার ছত্রাক’ কর্ডিসেপস এখন দেশটির অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠছে।

তবে বাণিজ্য ঘাটতি মোকাবিলা, রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্য এবং আন্তর্জাতিক মান রক্ষা করে ভবিষ্যৎ রপ্তানি বৃদ্ধিই হবে ভুটানের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button