বিশ্ব

রয়টার্সের অনুসন্ধান: পালানোর সময় আমিরাতে বিপুল সম্পদ পাঠান বাশার আল আসাদ

প্রায় দুই দশকের শাসনের ইতি টেনে গত ৮ই ডিসেম্বর সিরিয়ার ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় বাশার আল আসাদকে। দামেস্কের রাজপথে গর্জে ওঠা সশস্ত্র বিদ্রোহ আর বিদ্রোহীদের দখলে রাজধানীর পতনের মধ্য দিয়ে ঘটে এই নাটকীয় পালাবদল। এরপরই এক প্রকার অজ্ঞাত রহস্যে হারিয়ে যান সিরিয়ার দীর্ঘ সময়ের শাসক বাশার আল আসাদ। অবশেষে সম্প্রতি বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পর আসাদের পালিয়ে যাওয়ার পেছনের ঘটনা ক্রমে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে।

রয়টার্সের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, আসাদ তার পতনের আগেই অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ব্যক্তিগত সম্পদ এবং ঘনিষ্ঠজনদের নিরাপদ গন্তব্যে পাঠিয়ে দেন। সিরিয়া থেকে তার এই প্রস্থান শুধু শারীরিক নয়; বরং বিপুল অঙ্কের অর্থ, স্বর্ণ ও মূল্যবান সম্পদ স্থানান্তরের একটি সুপরিকল্পিত কৌশলও এর সঙ্গে যুক্ত ছিল।

রাশিয়ায় পলায়নের আগে ‘বিশেষ প্রস্তুতি’

রয়টার্সের তথ্যানুযায়ী, দামেস্ক পতনের আগেই আসাদ ও তার পরিবার পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সিরিয়ার উপকূলীয় শহর লাতাকিয়ার কাছে অবস্থিত একটি রুশ বিমানঘাঁটি থেকে এম্ব্রায়ার সিক্স হান্ড্রেড মডেলের একটি ব্যক্তিগত বিমানে রাশিয়ার উদ্দেশ্যে দেশ ত্যাগ করেন তিনি। এই বিমানে শুধু আসাদই নন, তার স্ত্রী, সন্তান এবং ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের একটি নির্ধারিত দলও সঙ্গে ছিল।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, শুধু নিজেকে এবং পরিবারকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়াই ছিল না আসাদের লক্ষ্য। দেশ ছাড়ার আগে একাধিক দফায় বিপুল পরিমাণ নগদ ডলার, স্বর্ণালঙ্কার ও মূল্যবান গহনা সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাঠানো হয়। এমনকি একটি ব্যাগেই ছিল ৫ লাখ মার্কিন ডলার। শুধু একটিই নয়, এ রকম বেশ কয়েকটি ব্যাগ প্রেরণ করা হয় আমিরাতে।

ল্যাপটপে ধরা পড়লো গোপন বিনিয়োগের নকশা

সম্পদ প্রেরণের পাশাপাশি বিমানে ছিল বেশ কিছু ল্যাপটপ, যার প্রতিটিই ছিল আসাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা সাম্রাজ্যের নথিতে ভরপুর। রয়টার্সের দাবি, এসব ল্যাপটপে ছিল আসাদ এবং তার ঘনিষ্ঠদের ব্যাংক হিসাব, টেলিকম খাত, আবাসন প্রকল্প, জ্বালানি বাণিজ্যসহ একাধিক আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। শুধু আর্থিক দলিল-দস্তাবেজই নয়, বলা হচ্ছে এই ল্যাপটপগুলোতে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং রাশিয়ায় ছড়িয়ে থাকা সম্পদের বিস্তারিত রেকর্ডও রয়েছে।

এই সম্পদ স্থানান্তরের পুরো প্রক্রিয়ার দেখভাল করেন আসাদের ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ইয়াসার ইব্রাহিম। তার পরিকল্পনা ও তত্ত্বাবধানে এম্ব্রায়ার ৬০০ মডেলের উড়োজাহাজ ব্যবহার করে অন্তত চারবার সিরিয়া থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ফ্লাইট পরিচালিত হয়।

গোপন বিমানের রহস্য

রয়টার্সের তথ্যমতে, এই বিশেষ ফ্লাইটগুলো পরিচালনা করেছিল একটি লেবানিজ ব্যবসায়ী, মোহাম্মদ ওয়েহবে, যিনি মূলত আরব বিশ্বের অভিজাত শ্রেণির সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক বজায় রাখেন। বিমানটির নিবন্ধন ছিল গাম্বিয়ার নামে, ফ্লাইট নম্বর ছিল ‘সিফাইভ-স্কাই’। এই বিমানটি আল বাতিন এক্সিকিউটিভ এয়ারপোর্টে অবতরণ করে, যা আরব রাজপরিবার, ধনকুবের ব্যবসায়ী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের ব্যক্তিগত সফরের জন্য নির্ধারিত একটি বিশেষ বিমানবন্দর।

এই এয়ারপোর্টটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে আন্তর্জাতিক কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া অনেকটাই গোপনীয় এবং সহজ। ফলে উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের অবাধে এবং নীরবে যাতায়াত নিশ্চিত হয়। ধারণা করা হচ্ছে, এই সুযোগকেই কাজে লাগিয়েই আসাদের পক্ষ থেকে বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ এবং মূল্যবান সম্পদ স্থানান্তর করা হয়।

শক্ত প্রমাণ ও অন্তরালের ১৪টি সূত্র

এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরিতে রয়টার্স কমপক্ষে ১৪টি আলাদা সূত্র ব্যবহার করেছে। সিরিয়ার বিদ্রোহীদের ঘনিষ্ঠ, দামেস্ক বিমানবন্দর ও আল বাতিন বিমানবন্দরের কর্মকর্তা, প্রেসিডেন্ট গার্ডের সাবেক ও বর্তমান সদস্য এবং আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তির সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।

রয়টার্সের এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর আন্তর্জাতিক পরিসরে নতুন করে আলোচনায় এসেছে সিরিয়া এবং আসাদ পরিবারের সম্পদ আড়াল ও পাচারের ইস্যু। ইতোমধ্যেই মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিষয়টি তদন্তের দাবি জানিয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, এ ধরনের সম্পদ স্থানান্তর কেবল দুর্নীতির চিত্রই স্পষ্ট করে না, বরং এই ঘটনাগুলো বৈশ্বিক অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্যও উদ্বেগজনক। কারণ, রাজনৈতিক নেতাদের গোপনে সম্পদ পাচার আন্তর্জাতিক বিধিমালাকে অবজ্ঞা করার একটি দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

‘নিয়ন্ত্রিত পালানো’ এবং বৈশ্বিক সমর্থন

অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, আসাদের এই পলায়ন আসলে ছিল দীর্ঘমেয়াদি আন্তর্জাতিক সমর্থনপ্রাপ্ত একটি ‘নিয়ন্ত্রিত প্রস্থান’ পরিকল্পনার অংশ। এতে রাশিয়া এবং আরব বিশ্বের একাধিক প্রভাবশালী পক্ষ জড়িত থাকার ইঙ্গিত মিলেছে। বিশেষ করে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো অর্থনৈতিক নিরাপদ আশ্রয়গুলোকে ব্যবহার করে দ্রুত অর্থ স্থানান্তর এবং পরবর্তী সময়ে সেই অর্থ ব্যবহারের কৌশল সাজানো হয়।

সিরিয়ার বিদ্রোহীদের মতে, আসাদ পরিবার বছরের পর বছর ধরে দেশের অর্থনীতি, জ্বালানি খাত এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে তাদের ব্যক্তিগত সম্পদ গড়ে তোলার জন্য ব্যবহার করেছে। দামেস্কে দখলদারিত্বের শেষ পর্যায়েও রাষ্ট্রীয় কোষাগার খালি করে তড়িঘড়ি এই সম্পদ সরিয়ে ফেলা হয়।

আন্তর্জাতিক নীতিমালার চ্যালেঞ্জ

বিশ্বব্যাপী অর্থ পাচার, দুর্নীতি এবং অবৈধ সম্পদ গচ্ছিতকরণ প্রতিরোধে বহু সংস্থা কাজ করলেও, বাস্তবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। বাশার আল আসাদের এই ঘটনা সেই পুরনো বাস্তবতাই সামনে এনেছে।

রয়টার্সের প্রতিবেদন বলছে, আসাদের ঘনিষ্ঠ একাধিক ব্যক্তি ইতোমধ্যে আমিরাতে বিলাসবহুল আবাসন, ব্যাংকিং এবং ব্যবসায়িক অংশীদারিত্ব গড়ে তুলেছেন। একাধিক নামী-দামী প্রপার্টি, শেয়ার মার্কেট এবং ক্রিপ্টো কারেন্সিতেও বিনিয়োগ রয়েছে তাদের।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই অর্থ সম্পদ মূলত যুদ্ধকালীন দুর্নীতি ও বিদেশি তহবিল থেকে গড়ে তোলা হয়েছিল। ২০২৩ সালের পর সিরিয়ার অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তার একটি বড় অংশও বিভিন্ন চ্যানেলের মাধ্যমে লোপাট হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

শেষ কথা

আন্তর্জাতিক রাজনীতির মঞ্চে বাশার আল আসাদের বিদায় ছিল এক নাটকীয় অধ্যায়ের সমাপ্তি। তবে তার সম্পদ এবং রাজনৈতিক প্রভাব এখনো মধ্যপ্রাচ্যের শক্তি কাঠামোয় ছায়া ফেলে আছে। রয়টার্সের অনুসন্ধান নতুন করে প্রমাণ করেছে, ক্ষমতার পতনের আগেও একনায়করা কতটা সুপরিকল্পিতভাবে নিজের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে রাখেন।

সিরিয়ার মানুষের জন্য যা থেকে যায়, তা হলো — ধ্বংস, যুদ্ধের ক্ষত আর অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব। ভবিষ্যত তদন্তে হয়তো আরও অনেক বিস্ফোরক তথ্য সামনে আসবে, কিন্তু এ ঘটনায় স্পষ্ট — আধুনিক বিশ্বে দুর্নীতি আর রাজনৈতিক ক্ষমতার আঁতাত আজও অটুট।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button