অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে পাকিস্তানে বৈধ হচ্ছে ক্রিপ্টোকারেন্সি

দেশটির দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে পাকিস্তান সরকার ক্রিপ্টোকারেন্সি ট্রেডিংকে বৈধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চলতি বছরের শুরু থেকেই দেশটি নজিরবিহীন আর্থিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। ঋণের বোঝা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমছে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ হিসেবে সরকার এবার ব্লকচেইন প্রযুক্তি ও ডিজিটাল সম্পদের গ্রহণযোগ্যতাকে বাড়ানোর পদক্ষেপ নিচ্ছে।
ক্রিপ্টো বৈধকরণের পেছনের কারণ
পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রীর প্রধান উপদেষ্টা এবং নবগঠিত পাকিস্তান ক্রিপ্টো কাউন্সিলের (পিসিসি) প্রধান নির্বাহী বিলাল বিন সাকিব সম্প্রতি ব্লুমবার্গ টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, সরকার একটি নিয়ন্ত্রক কাঠামো তৈরি করার পরিকল্পনা করছে যা ব্লকচেইন প্রযুক্তিকে আর্থিক ব্যবস্থার সাথে সংহত করবে।
তিনি বলেন, “পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে ক্রিপ্টোকারেন্সির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে চলেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূলত মানি লন্ডারিং, জালিয়াতি ও অন্যান্য আর্থিক ঝুঁকি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। কিন্তু এখন বিশ্বব্যাপী ক্রিপ্টোকারেন্সির জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়ায় এটি উপেক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।”
বিশ্বব্যাপী ক্রিপ্টো গ্রহণের ক্ষেত্রে পাকিস্তান বর্তমানে নবম স্থানে রয়েছে। দেশটির আনুমানিক ১৫ থেকে ২০ মিলিয়ন মানুষ ইতোমধ্যে ডিজিটাল সম্পদের ব্যবসার সাথে যুক্ত, যা ক্রিপ্টো ট্রেডিং বৈধ করার পক্ষে একটি গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি হয়ে উঠেছে।
ক্রিপ্টো বৈধকরণের সম্ভাব্য সুফল
বিশ্লেষকদের মতে, পাকিস্তানে ক্রিপ্টোকারেন্সিকে বৈধতা দিলে দেশটির অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এর মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সুবিধা হলো:
- বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা: একটি নিয়ন্ত্রিত ক্রিপ্টো মার্কেট বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে। সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে ক্রিপ্টো-বান্ধব নীতি গ্রহণ করেছে, যা পাকিস্তানকেও এই পথে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করছে।
- কর রাজস্ব বৃদ্ধি: সরকার ক্রিপ্টো লেনদেনের উপর কর আরোপ করতে পারবে, যা দেশের রাজস্ব বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। আইএমএফ ইতোমধ্যে পাকিস্তানকে কর নীতির আওতায় ক্রিপ্টোকে অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছে।
- ব্লকচেইন প্রযুক্তির উন্নয়ন: ক্রিপ্টোকে বৈধ করলে ব্লকচেইন প্রযুক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিস্তার ঘটবে, যা আর্থিক খাতকে আরও স্বচ্ছ ও নিরাপদ করবে।
- ঋণের বোঝা কমানো: সরকারের বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরতা কমাতে ডিজিটাল সম্পদের ব্যবহার সহায়ক হতে পারে।
সরকারের পরিকল্পনা ও নীতিমালা
পাকিস্তান সরকার সম্প্রতি পাকিস্তান ক্রিপ্টো কাউন্সিল (পিসিসি) গঠন করেছে। এ কাউন্সিলের নেতৃত্বে রয়েছেন অর্থমন্ত্রী মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব। এছাড়া, স্টেট ব্যাংক অফ পাকিস্তানের গভর্নর এবং সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যানসহ গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কর্মকর্তারা এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন।
ক্রিপ্টো বাজারকে বৈধ করার ক্ষেত্রে সরকারের মূল লক্ষ্য হলো:
- সুস্পষ্ট প্রবিধান প্রণয়ন করা
- বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা
- অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা
- ব্লকচেইন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো
পিসিসির প্রধান নির্বাহী বিলাল বিন সাকিব বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হলো একটি সুরক্ষিত এবং নিয়ন্ত্রিত বাজার তৈরি করা, যাতে ক্রিপ্টো বিনিয়োগকারীরা নিরাপদে ব্যবসা করতে পারেন।”
চ্যালেঞ্জ ও প্রতিক্রিয়া
তবে, পাকিস্তানে ক্রিপ্টো বৈধ করার সিদ্ধান্তের বিরোধিতাও রয়েছে। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক সংস্থা এখনও ক্রিপ্টোর নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিয়ে শঙ্কিত। তারা মনে করে, সঠিক নিয়ন্ত্রণের অভাবে এটি মানি লন্ডারিং ও অন্যান্য অবৈধ কার্যকলাপে ব্যবহৃত হতে পারে।
এছাড়া, পাকিস্তানের কিছু ধর্মীয় নেতারাও ক্রিপ্টো বৈধকরণের বিরোধিতা করছেন, কারণ তারা মনে করেন এটি ইসলামী শরিয়াহ সম্মত নয়। তবে, এ বিষয়ে ফতোয়া জারি করার জন্য উলামাদের সাথে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী ক্রিপ্টো গ্রহণের বর্তমান চিত্র
বিশ্বের অনেক দেশই এখন ক্রিপ্টো-বান্ধব নীতি গ্রহণ করছে। উদাহরণস্বরূপ,
- যুক্তরাষ্ট্র: দেশটি বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে ক্রিপ্টোকে নিয়ন্ত্রণ করছে এবং একে আর্থিক ব্যবস্থায় সংহত করেছে।
- সংযুক্ত আরব আমিরাত: দুবাই ও আবুধাবি ক্রিপ্টো-সহায়ক পরিবেশ গড়ে তুলেছে এবং একে বৈধতা দিয়েছে।
- সিঙ্গাপুর: কঠোর বিধিবিধানের মাধ্যমে ক্রিপ্টো ব্যবসাকে পরিচালিত করছে।
পাকিস্তানও যদি একটি কার্যকর নিয়ন্ত্রক কাঠামো তৈরি করতে পারে, তাহলে এটি ক্রিপ্টো-বান্ধব দেশগুলোর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।