বানিজ্য

বিদ্যুতের দাম আপাতত না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত: অর্থ উপদেষ্টা

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বিদ্যুতের দাম আপাতত না বাড়ানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন। এই ঘোষণার পাশাপাশি জ্বালানি খাতে বরাদ্দ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো হয়েছে, যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। তবে বিদ্যুৎ খাতে বরাদ্দ কিছুটা কমানো হয়েছে, যা অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ও ব্যয় সাশ্রয়ের লক্ষ্যে সরকারের কৌশলগত পদক্ষেপের ইঙ্গিত দেয়।

বিদ্যুতের দাম স্থিতিশীল রাখার সিদ্ধান্ত

অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ তাঁর বাজেট বক্তৃতায় বলেন, “নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের পাশাপাশি অর্থনীতিকে সচল রাখতে জ্বালানির পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং একই সঙ্গে তা সাশ্রয়ী রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বিদ্যুতের মূল্য আপাতত না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” এই সিদ্ধান্ত দেশের মূল্যস্ফীতির চাপে থাকা জনগণের জন্য স্বস্তির বার্তা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই পদক্ষেপ অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও জনগণের ক্রয়ক্ষমতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ জিডিপির প্রায় ১ শতাংশ, যা অর্থনীতির জন্য উল্লেখযোগ্য বোঝা। এই ভর্তুকি ক্রমান্বয়ে কমাতে সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ১০ শতাংশ হ্রাস করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। অর্থ উপদেষ্টা জানান, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব হবে। এছাড়া, বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিগুলো পর্যালোচনা করে ব্যয় হ্রাসের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এনার্জি অডিটের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়ার দক্ষতা বৃদ্ধির পরিকল্পনাও হাতে নেওয়া হয়েছে।

জ্বালানি খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি

প্রস্তাবিত বাজেটে জ্বালানি খাতে ২ হাজার ১৭৮ কোটি টাকার বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে, যার মধ্যে উন্নয়ন বরাদ্দ ২ হাজার ৮৬ কোটি টাকা। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৮৭ কোটি টাকা, যা সংশোধিত বাজেটে কমে ১ হাজার ৫৩ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। নতুন বাজেটে এই খাতে বরাদ্দ দ্বিগুণেরও বেশি করা হয়েছে, যা দেশীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর সরকারের জোর দেওয়ার প্রতিফলন।

অর্থ উপদেষ্টা জানান, জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার নিজস্ব উদ্যোগে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ২০২৫-২৬ থেকে ২০২৭-২৮ অর্থবছরের মধ্যে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স) ২৭০ কিলোমিটার ভূতাত্ত্বিক জরিপ, ৭০০ কিলোমিটার দ্বিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ এবং ৭০০ কিলোমিটার ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ পরিচালনা করবে। এছাড়া, মধ্যমেয়াদে বাপেক্স নিজস্ব রিগের মাধ্যমে ৬৯টি কূপ খনন ও ৩১টি কূপ সংস্কারের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এই উদ্যোগগুলো দেশীয় গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি ও আমদানি নির্ভরতা কমাতে সহায়ক হবে।

পরিশোধিত জ্বালানি তেলের চাহিদা মেটাতে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপনের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, যার মাধ্যমে বছরে ৩০ লাখ মেট্রিক টন অপরিশোধিত তেল পরিশোধন করা সম্ভব হবে। এই প্রকল্প জ্বালানি খাতে স্থায়িত্ব ও সাশ্রয়ী মূল্য নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

বিদ্যুৎ খাতে বরাদ্দ হ্রাস

জ্বালানি খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির বিপরীতে বিদ্যুৎ খাতে বরাদ্দ কিছুটা কমানো হয়েছে। চলতি অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে বরাদ্দ ছিল ২৯ হাজার ২৩০ কোটি টাকা, যা সংশোধিত বাজেটে কমে ২১ হাজার ৬৫১ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ বাজেটে এই খাতে ২০ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে, যার মধ্যে উন্নয়ন বরাদ্দ ২০ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা। এই হ্রাস অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানোর অংশ হিসেবে সরকারের নীতিগত অবস্থানের প্রতিফলন।

বাজেটে বিদ্যুৎ বিতরণব্যবস্থা আধুনিকায়নের জন্য মেট্রোপলিটন এলাকায় বিতরণ লাইন ও সাবস্টেশন ভূগর্ভস্থ করার কাজের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। এই উদ্যোগ বিদ্যুৎ সরবরাহের স্থিতিশীলতা ও কার্যকারিতা বাড়াবে। এছাড়া, নেপাল থেকে ৪০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ সাশ্রয়ী মূল্যে আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হবে, যা দেশের বিদ্যুৎ সরবরাহে নতুন মাত্রা যোগ করবে।

নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও শুল্ক সংস্কার

বাজেটে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা-২০০৮ আধুনিকায়ন করে নতুন নীতিমালা প্রণয়নের কাজ প্রায় চূড়ান্ত। ২০৪০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া, ২০২৮ সালের মধ্যে ৩ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পরিচ্ছন্ন উৎস থেকে উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে।

তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা এলএনজি আমদানি খরচ কমাবে। জ্বালানি তেল আমদানিতে শুল্ক কাঠামোতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ এবং পরিশোধিত জ্বালানি তেলের শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই শুল্ক হ্রাস বেসরকারি খাতের আমদানি খরচ কমাবে, যদিও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) খরচে তেমন প্রভাব পড়বে না।

বিশ্লেষকদের মতামত

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশনের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, “বিদ্যুতের দাম না বাড়ানো এবং এলএনজির শুল্ক প্রত্যাহার ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে জ্বালানি তেল থেকে রাজস্ব আদায় যাতে না বাড়ে, তা নিশ্চিত করতে হবে। জ্বালানি খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হলেও তা প্রকল্প বাস্তবায়নে অপ্রতুল। জ্বালানি সুবিচার নিশ্চিত করতে বাজেটে আরও সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা প্রয়োজন।”

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, জ্বালানি খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি ও বিদ্যুতের দাম স্থিতিশীল রাখার সিদ্ধান্ত অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হলেও, বাজেট বাস্তবায়নে রাজস্ব আদায় ও ঋণ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা চ্যালেঞ্জ হবে।

উপসংহার

২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বিদ্যুতের দাম না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত এবং জ্বালানি খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি সরকারের জনকেন্দ্রিক ও টেকসই উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করে। তবে, জ্বালানি নিরাপত্তা, ব্যয় সাশ্রয় ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আরও সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন। এই বাজেট অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ও জনগণের স্বস্তি নিশ্চিত করতে সফল হবে কিনা, তা নির্ভর করবে বাস্তবায়নের কার্যকারিতার ওপর।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button