আগামী ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে মিয়ানমারে নির্বাচন: জান্তাপ্রধান

মিয়ানমারের সামরিক সরকার আগামী ডিসেম্বর বা ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের পরিকল্পনা করেছে। দেশটির জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লাইং তাঁর সাম্প্রতিক বেলারুশ সফরের সময় এই সময়সূচির কথা জানান। এটি প্রথমবারের মতো, যখন জান্তাপ্রধান নির্দিষ্ট একটি সময়ের উল্লেখ করলেন।
২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী। এর পর থেকে দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা অব্যাহত রয়েছে। জান্তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠী সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করেছে, যা দেশটির নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
নির্বাচন নিয়ে প্রতিশ্রুতি ও সন্দেহ
মিয়ানমারের সামরিক জান্তা এর আগেও নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে তারা বারবার জরুরি অবস্থা বাড়ানোর মাধ্যমে নির্বাচন পিছিয়ে দিয়েছে। সামরিক সরকারের এই নির্বাচন কতটা অবাধ ও সুষ্ঠু হবে, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক সন্দেহ রয়েছে। সমালোচকেরা এই নির্বাচনকে ‘প্রহসন’ বলে অভিহিত করেছেন এবং দাবি করেছেন যে, সামরিক জান্তা নিজেদের ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার জন্যই এটি আয়োজন করছে।
গত কয়েক বছরে মিয়ানমারে ২৪টিরও বেশি রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যার মধ্যে অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) অন্যতম। এনএলডির বিপুল জনপ্রিয়তা থাকলেও জান্তা সরকার দলটির রাজনৈতিক কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। ফলে এই নির্বাচনে প্রকৃত গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো অংশ নিতে পারবে কিনা, তা নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ রয়েছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর প্রতিক্রিয়া
মিয়ানমারে বর্তমানে শতাধিক বিদ্রোহী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে, যারা জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই করছে। সামরিক সরকার বিরোধী এসব গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে দেশটির বিশাল অংশ রয়েছে। জান্তা বাহিনী একাধিকবার চেষ্টা করেও পুরো দেশের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জান্তা যদি নির্বাচন আয়োজন করে, তবে তা আরও সহিংসতার জন্ম দিতে পারে। কারণ, সামরিক সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে বিরোধী দল ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মতে, এই নির্বাচন সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা বৈধতা দেওয়ার জন্যই অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তারা ইতোমধ্যে নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে।
জনশুমারি প্রতিবেদন ও নির্বাচনের সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ
মিয়ানমারের সামরিক সরকার জানিয়েছে, নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে তারা জনশুমারি পরিচালনা করেছে। তবে বাস্তব পরিস্থিতি বলছে ভিন্ন কথা। ডিসেম্বরের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, মিয়ানমারের ৩৩০টি শহরের মধ্যে মাত্র ১৪৫টিতে সরেজমিনে জনশুমারি পরিচালনা করা সম্ভব হয়েছে। দেশটিতে চলমান সংঘাতের কারণে অনেক এলাকায় সরকারি কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না।
নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে আয়োজন করতে গেলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি বেশ কঠিন হবে বলে মনে করা হচ্ছে। একদিকে জান্তা সরকার ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইছে, অন্যদিকে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোও নিয়ন্ত্রণ বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘাত আরও তীব্র হতে পারে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ অনুমান
মিয়ানমারের সামরিক সরকারের ঘোষিত নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়াও গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন এর আগেও মিয়ানমারের জান্তার বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তারা জান্তার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে এবং গণতন্ত্র পুনর্বহালের আহ্বান জানিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই নির্বাচন যদি সেনাবাহিনীর অধীনে অনুষ্ঠিত হয়, তবে তা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পাওয়া কঠিন হবে। কারণ, সেনাবাহিনীর প্রভাবমুক্ত ও স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে গভীর সন্দেহ রয়েছে।
অন্যদিকে, চীন ও রাশিয়ার মতো দেশগুলো মিয়ানমারের সামরিক জান্তার প্রতি সমর্থন জানিয়ে আসছে। তারা জান্তার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে এবং অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করছে। তবে পশ্চিমা বিশ্ব সামরিক জান্তার নির্বাচন পরিকল্পনার বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
শেষ কথা
মিয়ানমারে আসন্ন সাধারণ নির্বাচন দেশটির রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সামরিক জান্তার এই নির্বাচন দেশটিতে স্থিতিশীলতা আনবে নাকি আরও সংঘাতের জন্ম দেবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে বর্তমান বাস্তবতায় বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর প্রতিরোধ, আন্তর্জাতিক চাপ এবং জনগণের মনোভাব এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার ওপর বড় প্রভাব ফেলবে।