বানিজ্য

গণঅভ্যুত্থানের পর বন্ধ কারখানা চালু করতে হিমশিম খাচ্ছেন মালিকরা

গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের শিল্পখাতে নেমে আসে এক গভীর অনিশ্চয়তা। বিশেষ করে, যেসকল কলকারখানায় ভাঙচুর বা আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটেছিল, সেগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে দেখা দেয় চরম শঙ্কা। আর্থিক সংকট, ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তিতে জটিলতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে কারখানাগুলো চালু করা ছিল এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। প্রায় এক লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান জড়িত ছিল এই কারখানাগুলোর সাথে, যাদের জীবন ও জীবিকা আজ হুমকির মুখে।

গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এবং জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত শ্রমিক অসন্তোষের সময় এই ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হয়। দীর্ঘ সাত মাস ধরে কারখানাগুলো বন্ধ থাকায়, ব্যাংকগুলোও নতুন করে ঋণ দিতে বা পূর্বের ঋণ পুনঃতফসিল করতে অপারগতা প্রকাশ করে। ফলে, কারখানা মালিকরা এক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হন।

ক্ষতিগ্রস্ত কারখানাগুলোর মধ্যে ছিল বেক্সিমকো গ্রুপের ১৪টি পোশাক কারখানা, গাজী গ্রুপের পাঁচটি টায়ার কারখানা, বেঙ্গল গ্রুপের তিনটি প্লাস্টিক কারখানা এবং আশুলিয়া, সাভার, জিরাবো ও জিরানীর বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানা।

গাজী গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক (অর্থ) মুহাম্মদ ফখরুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে জানান, আগামী তিন থেকে চার মাসের মধ্যে কারখানাগুলো পুনর্গঠনের কাজ শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে। শিল্পগোষ্ঠীটি প্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ পুনঃতফসিল করে পুনরায় কার্যক্রম শুরু করতে আগ্রহী।

গত বছরের আগস্টে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গাজী গ্রুপের পাঁচটি কারখানা পোড়ানো ও লুটপাটের ঘটনায় প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীরের গাজী টায়ার, গাজী ট্যাংক, গাজী পাইপ, গাজী ডোরসসহ বেশ কয়েকটি গুদামও ধ্বংস করা হয়।

বেক্সিমকো গ্রুপের ক্ষেত্রে, সরকার আগামী ৯ মার্চ থেকে ৩১ হাজার ৬৬৯ শ্রমিক ও ১ হাজার ৫৬৫ কর্মকর্তাকে মোট ৫২৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকা চূড়ান্ত বেতন ও সেবা সুবিধা প্রদান করবে। আগস্টের শুরুতে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বেক্সিমকো গ্রুপ গভীর সংকটে পড়ে। বেক্সিমকোর ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান, যিনি পদচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রভাবশালী উপদেষ্টা ছিলেন, তার বিরুদ্ধে হত্যা, দুর্নীতি ও ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক লাভের জন্য রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহারের অভিযোগ আনা হয়।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর, বেক্সিমকো গ্রুপের প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণসহ সালমান এফ রহমান ও তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অনিয়ম প্রকাশ্যে আসে। নগদ টাকার সংকটে থাকা শিল্পগোষ্ঠীটির শীর্ষ কর্মকর্তারা সীমিত আকারে ব্যবসা শুরু করার জন্য সরকারের কাছে এলসি খোলার অনুমতি চেয়ে বারবার অনুরোধ করেন।

বেক্সিমকো গ্রুপের বস্ত্র ও পোশাক বিভাগের হেড অব হিউম্যান রিসোর্সেস (এইচআর) অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স খালিদ শাহরিয়ার ডেইলি স্টারকে বলেন, শ্রমিক ও তাদের পরিবারের কথা বিবেচনা করে কারখানাগুলো চালু করা জরুরি। তবে, বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও সরকার ব্যবসা শুরুর অনুমতি দেয়নি।

বেঙ্গল গ্রুপের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি জসিম উদ্দিন জানান, কেন্দ্রীয় গুদামসহ প্লাস্টিক ব্যাগ, সিমেন্ট ব্যাগ, প্যাকেজিং সামগ্রী তৈরির তিনটি কারখানা পুড়ে গেছে। জিরানীর এই কারখানাগুলোতে প্রায় ২ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন এবং প্রতি মাসে আয় হতো প্রায় ৮০ কোটি টাকা। কারখানা পুনর্নির্মাণ ও নতুন যন্ত্রপাতি কেনার জন্য ব্যাংক ঋণের ৪০০ কোটি টাকা পুনঃতফসিল করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা বিগ বসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ রেজাউল হোসেন কাজী জানান, আগস্ট-পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতিতে তাদের কারখানায় ৬০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। তবে, বিমার মাধ্যমে লোকসান পুষিয়ে নেওয়ায় কারখানাটি কয়েক দিনের মধ্যেই উৎপাদন শুরু করতে সক্ষম হয়। বর্তমানে বিগ বস প্রতিষ্ঠানে ১২ হাজার শ্রমিক কাজ করছেন এবং কারখানা চালু থাকায় ঋণ পরিশোধ নিয়ে বড় সমস্যায় পড়তে হয়নি।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল জানান, মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত অন্তত চারটি পোশাক কারখানা এখনও উৎপাদন শুরু করতে পারেনি। রাজনৈতিক কারণে কারখানাগুলো খোলার অনুমতি দেওয়া হয়নি বলে তিনি উল্লেখ করেন।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব এএইচএম শফিকুজ্জামান জানান, বেক্সিমকো ও টিএনজেডের বার্ডস, ডির্ড, ইয়েলোসহ পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে সরকার আর্থিক সহায়তা হিসেবে ১২৭ কোটি টাকা দিয়েছে। তবে, ছয় মাসের মেয়াদ শেষ হওয়ায় সরকার এখন এসব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ পরিশোধের জন্য চাপ দিচ্ছে। সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে সরকার জামানত হিসেবে সম্পত্তি বিক্রির চেষ্টা করবে। কয়েকটি কারখানা চালু থাকায় তারা ঋণ পরিশোধে সক্ষম হবে বলে তিনি মনে করেন।

বিজিএমইএর প্রশাসক মো. আনোয়ার হোসেন জানান, যেগুলোর মালিকরা বিদেশে বা বকেয়া ঋণে জর্জরিত, সেগুলো ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় সব পোশাক কারখানা চালু হয়েছে। শ্রমিক অসন্তোষ ও ভাঙচুরের কারণে উৎপাদন বন্ধ থাকায় গত বছরের জুলাই থেকে কয়েকটি কারখানা বন্ধ রয়েছে।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন জানান, মন্ত্রণালয় অনেক কারখানায় শ্রম ইস্যুতে কাজ করেছে এবং কয়েকটি কারখানায় বেতন পরিশোধের জন্য আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তবে, ক্ষতিগ্রস্ত সব কারখানার ব্যাংক ঋণ বকেয়া থাকায় তাদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এরপরও কোনো কারখানা মন্ত্রণালয়ের কাছে এলে তারা সহযোগিতা করার চেষ্টা করবেন।

শ্রমিকদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধার জন্য সরকারের আর্থিক সহায়তা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মানবিক কারণে এটি করা হয়েছে। কারণ এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রি করা জটিল ও সময়সাপেক্ষ। বেক্সিমকো গ্রুপের খেলাপি ঋণ এত বেশি যে সরকার তাদের কার্যক্রম আবার চালু করতে বড় ধরনের আর্থিক হস্তক্ষেপের ঝুঁকি নিতে পারে বলে তিনি মনে করেন।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button