বিশ্ব

জাতিসংঘে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বদলালো

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে কথা বলছেন ইউক্রেনের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী মারিয়ানা বেটসা। জাতিসংঘের সদর দপ্তর, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে কথা বলছেন ইউক্রেনের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী মারিয়ানা বেটসা। জাতিসংঘের সদর দপ্তর, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ছবি: রয়টার্স

রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় মিত্র ছিল যুক্তরাষ্ট্র। যুদ্ধের এই তিন বছরে ইউক্রেনকে অবিচলভাবে সমর্থন দিয়েছে দেশটি; কিন্তু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকে কিয়েভ নিয়ে অবস্থান বদলাতে শুরু করে ওয়াশিংটন।

গত সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে (ইউএনজিএ) ইউক্রেন যুদ্ধের তিন বছর পূর্তির দিন উত্থাপিত একটি প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউক্রেন ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিল। এতে ইউক্রেনে হামলা চালানোয় রাশিয়ার নিন্দা করা হয়।

ইউএনজিএতে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে একই দিন আলাদা করে যুক্তরাষ্ট্রও একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে। প্রস্তাবে সংঘাতের জন্য স্পষ্ট করে রাশিয়াকে দায়ী করা হয়নি।

অন্যদিকে নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে যুদ্ধের ইতি টানার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। ইউএনজিএতে উত্থাপিত এই দুই প্রস্তাব থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যে বাড়তে থাকা দূরত্বের চিত্র ফুটে উঠেছে। একইসঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের অধীন কিয়েভ নিয়ে ওয়াশিংটনের নীতির পরিবর্তন স্পষ্ট হয়েছে।

জাতিসংঘে প্রস্তাব নিয়ে কী ঘটেছিল গত সোমবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত ইউক্রেন ও তার মিত্রদের প্রস্তাবটির শিরোনাম ছিল ‘অ্যাডভান্সিং আ কম্প্রিহেনসিভ, জাস্ট অ্যান্ড লাস্টিং পিস ইন ইউক্রেন (ইউক্রেনে একটি সমন্বিত, ন্যায়সংগত ও স্থায়ী শান্তির লক্ষ্যে অগ্রসর হওয়া)। যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৮টি দেশ প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা করা এই প্রস্তাবে স্পষ্ট করে বলা হয়, কিয়েভ নয়, মস্কোই চলমান যুদ্ধ শুরু করেছিল ২০২২ সালে। এতে ইউক্রেনের ‘সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা, ঐক্য ও ভূখণ্ডের অখণ্ডতা’র পক্ষে অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করতে জাতিসংঘের সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

এতে অবৈধভাবে ভূখণ্ড দখলে নেওয়া বা বলপ্রয়োগের হুমকির বিরুদ্ধে ইউএনজিএর সদস্যদের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করতে আহ্বান জানানো হয়েছে। সংঘাতে জড়িত উভয় পক্ষকে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলতে এবং সাধারণ মানুষ- ‘বিশেষ করে নারী ও শিশু’র সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আহ্বান জানানো হয়েছে।

কিয়েভের ইউরোপীয় মিত্রদের উত্থাপিত এই প্রস্তাবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল, ইউক্রেন থেকে অবিলম্বে রুশ সেনাদের ফিরিয়ে নেওয়া এবং যুদ্ধের সমাপ্তি টানা। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পাশাপাশি আরও যেসব দেশ প্রস্তাবটির বিরোধিতা করেছে, সেগুলোর মধ্যে ইসরায়েল, উত্তর কোরিয়া ও হাঙ্গেরি অন্যতম।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প (ডানে) ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। নিউইয়র্ক সিটির ট্রাম্প টাওয়ারে, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প (ডানে) ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। নিউইয়র্ক সিটির ট্রাম্প টাওয়ারে, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ফাইল ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে কী ছিল জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের উত্থাপিত প্রস্তাবের শিরোনাম ছিল ‘দ্য পাথ টু পিস’। এতে রাশিয়া ও ইউক্রেনে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু যুদ্ধ শুরু করা নিয়ে কোনো দেশকে দায়ী করা হয়নি।

প্রস্তাবে ‘রুশ প্রজাতন্ত্র–ইউক্রেন যুদ্ধে প্রাণহানির ঘটনা’য় শোক প্রকাশ করা হয়। এতে জোর দিয়ে বলা হয়, জাতিসংঘের উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষা এবং ‘শান্তিপূর্ণভাবে বিরোধের মীমাংসা’।

তবে প্রস্তাবের খসড়ায় কিছু সংশোধনী এনেছিল ফ্রান্স। তাদের সংশোধনীতে রাশিয়া পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধ শুরু করেছিল বলে উল্লেখ করা হয় এবং ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও ভূখণ্ডের অখণ্ডতার কথা বলা হয়।

ফ্রান্সের সংশোধনীর পর প্রস্তাবটি ইউএনজিএতে পাস হয়। এতে পক্ষে ভোট পড়ে ৯৩টি। বিপক্ষে পড়ে ৮টি। ভোটদানে বিরত থাকে ৭৩টি দেশ। যুক্তরাষ্ট্রও প্রস্তাবটিতে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকে।

পরে নিজেদের মূল প্রস্তাবটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে (ইউএনএসসি) নিয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে এটি ১০–০ ভোটে পাস হয়। পাঁচটি দেশ ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকে। দেশগুলো হলো যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, গ্রিস ও স্লোভেনিয়া।

নিরাপত্তা পরিষদে পাস হওয়া প্রস্তাব মানতে দেশগুলো আইনত বাধ্য; কিন্তু সাধারণ পরিষদের পাস হওয়া প্রস্তাবের ক্ষেত্রে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবে এখানে বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়। কোনো সংঘাতকে বিশ্ব কীভাবে দেখছে, ইউএনজিএর প্রস্তাব মাঝেমধ্যে তা প্রভাবিত করে।

যুক্তরাষ্ট্রের আগের অবস্থানের সঙ্গে পার্থক্য কোথায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ক্রেমলিনে গিনি-বিসাউয়ের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকে, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ক্রেমলিনে গিনি-বিসাউয়ের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকে, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ছবি: এএফপি

যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এর আগে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে উত্থাপিত ছয়টি প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গত সোমবার পাস হওয়া দুটি প্রস্তাবও ছিল আগেরগুলোর মতোই।

রাশিয়া নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়ায় সেখানে উত্থাপিত প্রস্তাবের বিপক্ষে দেশটির ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। স্থায়ী সদস্যদের কেউ ভেটো দিলে নিরাপত্তা পরিষদে কোনো প্রস্তাব পাস হয় না। সে কারণে ইউক্রেনের পক্ষে প্রস্তাব পাসের জন্য সাধারণ পরিষদ গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পরিণত হয়েছিল।

সাধারণ পরিষদে পাস হওয়া আগের ছয় প্রস্তাব সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। কিয়েভে, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। কিয়েভে, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ছবি: রয়টার্স

  • ২০২২ সালের ৩ মার্চ: ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে রাশিয়া। রাশিয়ার ভাষায় যা ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ হিসেবে পরিচিত। এই দিনে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পাস হওয়া একটি প্রস্তাবে রাশিয়ার এই সামরিক অভিযানের নিন্দা জানানো হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৪১টি দেশ প্রস্তাবটির পক্ষে ভোট দেয়। এতে জোরপূর্বক ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণে নেওয়াকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল। পাশাপাশি রাশিয়াকে বল প্রয়োগের ব্যবহার বন্ধ করতে এবং ইউক্রেনের ভূখণ্ড থেকে রুশ সেনা প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছিল। পাঁচটি দেশটি প্রস্তাবটির বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল।
  • ২০২২ সালের ২৪ মার্চ : এই দিন পাস হওয়া প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৩৯টি দেশ ভোট দিয়েছিল। প্রস্তাবে ‘ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা, ঐক্য ও ভূখণ্ডের অখণ্ডতা’র কথা পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছিল। রুশ সেনা প্রত্যাহারের দাবিও জানানো হয়েছিল।
  • ২০২২ সালের এপ্রিল: জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে রাশিয়ার সদস্যপদ স্থগিত করার জন্য উত্থাপিত প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রসহ ৯৩টি দেশ ভোট দিয়েছিল।
  • ২০২২ সালের অক্টোবর: ইউক্রেনের অধিকৃত ভূখণ্ড আইন পাস করে নিজেদের অংশ করে নিয়েছিল রাশিয়া। রাশিয়ার এই পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়ে পাস হওয়া প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৪৩টি দেশ ভোট দিয়েছিল।
  • ২০২২ সালের নভেম্বর: রাশিয়ার প্রতি ইউক্রেনকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে উত্থাপিত প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রসহ ৯৪টি দেশ। বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল ১৪টি দেশ। এই প্রস্তাবেও রাশিয়াকে বলপ্রয়োগ বন্ধ ও সেনা প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়েছিল।
  • ২০২৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি: এ দিন পাস হওয়া একটি প্রস্তাবে রাশিয়ার জোর করে ইউক্রেনের ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণে নেওয়া অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত করা এবং ইউক্রেন থেকে রুশ সেনা প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৪১টি দেশ প্রস্তাবটির পক্ষে ভোট দিয়েছিল। বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল সাতটি দেশ।

কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে গত সোমবারের আগ পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদে কোনো প্রস্তাব পাস হয়নি।

আরও পড়ুন ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের ৬৫ শব্দের নতুন প্রস্তাব ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের ৬৫ শব্দের নতুন প্রস্তাব

বিশ্বকে কী বার্তা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের উপরাষ্ট্রদূত ডরোথি শিয়া গত সোমবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে এর আগে একাধিক প্রস্তাব পাস করা হয়েছে। এসব প্রস্তাবে ইউক্রেন থেকে রুশ সেনা প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছিল; কিন্তু এসব প্রস্তাব ‘যুদ্ধ বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে’।

ভোটাভুটির আগে শিয়া বলেন, যুদ্ধকে ‘অনেক বেশি সময় ধরে চলছে’। এতে রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয় দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

সোমবার ভোটাভুটির আগে ডরোথি শিয়া বলেন, ‘আমাদের এমন একটি প্রস্তাব দরকার, যাতে টেকসইভাবে যুদ্ধের ইতি টানার বিষয়ে জাতিসংঘের সব সদস্যের প্রতিশ্রুতি থাকবে।’ নিজেদের উত্থাপিত প্রস্তাবকে তিনি ‘শান্তির পথে’ প্রথম পদক্ষেপ বলে বর্ণনা করেন।

তাঁর এই বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মেয়াদে জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত লিন্ডা থমাস-গ্রিনফিল্ডের বক্তব্য থেকে অনেক আলাদা। ২০২৪ সালের নভেম্বরে ইউএনএসসির বৈঠকে লিন্ডা থমাস-গ্রিনফিল্ড বলেছিলেন, ‘প্রতিদিন ইউক্রেনের পরিবারগুলো রাশিয়ার যুদ্ধাপরাধের আতঙ্কে থাকে। আজ পর্যন্ত [রাশিয়ার] সেনারা প্রায় ১ লাখ ৪৭ হাজার যুদ্ধাপরাধ করেছেন। প্রতি রাতে ইউক্রেনের পরিবারগুলো রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার ভয়ে থাকে। এসব হামলা দেশটিকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে।’

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button