ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবে ১৬ পাকিস্তানির মৃত্যু

ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার সময় লিবিয়া উপকূলে নৌকাডুবিতে ১৬ পাকিস্তানি অভিবাসনপ্রত্যাশীর মৃত্যু হয়েছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এ ঘটনায় ৩৭ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে, তবে আরও ১০ জন নিখোঁজ রয়েছেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি অনুসারে, দুর্ঘটনাগ্রস্ত নৌকাটিতে মোট ৬৩ জন পাকিস্তানি ছিলেন। উদ্ধার হওয়া ৩৭ জনের মধ্যে ১ জনকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে, আর বাকি ৩৩ জনকে পুলিশের হেফাজতে রাখা হয়েছে। নিখোঁজদের সন্ধানে উদ্ধার অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ।
ঘটনার পটভূমি
লিবিয়া থেকে অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশের জন্য প্রায়ই অভিবাসনপ্রত্যাশীরা নৌকায় করে ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা করে থাকেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব নৌকা অতিরিক্ত যাত্রী বহন করায় এবং প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় দুর্ঘটনা ঘটে। লিবিয়া উপকূলে প্রায়ই এমন নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে, যেখানে প্রাণ হারান শত শত অভিবাসনপ্রত্যাশী।
স্থানীয় সূত্রের বরাত দিয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দুর্ঘটনাটি ঘটেছে গত সপ্তাহে, যখন লিবিয়ার উপকূলীয় এলাকা আল-ঝাওয়াইয়ার কাছে একটি নৌকা ডুবে যায়। এ ঘটনায় দ্রুত উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করা হলেও বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়। জীবিত উদ্ধার হওয়া অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মধ্যে কেউ কেউ গুরুতর অসুস্থ।
পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া
নৌকাডুবির ঘটনায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গভীর শোক প্রকাশ করেছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন এবং নিখোঁজদের সন্ধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। ইসলামাবাদে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘এই ধরনের অনিরাপদ অভিবাসন রোধ করতে সরকার সচেষ্ট থাকবে এবং বিদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানি নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’
এদিকে, ত্রিপোলিতে অবস্থিত পাকিস্তান দূতাবাসের একটি প্রতিনিধি দল দুর্ঘটনার পরপরই উপকূলীয় শহর আল-ঝাওয়াইয়া সফরে যায়। তারা স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং উদ্ধারকৃতদের খোঁজখবর নেন। দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, পাকিস্তানি নাগরিকদের যত দ্রুত সম্ভব দেশে ফেরানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
অভিবাসন সংকট ও ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা
গত কয়েক দশকে যুদ্ধ, দারিদ্র্য এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অনেক পাকিস্তানি, বাংলাদেশি, আফগান ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা উন্নত জীবনের আশায় ইউরোপের দিকে পাড়ি জমাচ্ছেন। অনেকেই লিবিয়াকে ইউরোপে প্রবেশের প্রধান রুট হিসেবে ব্যবহার করেন। তবে এই রুটটি অত্যন্ত বিপজ্জনক, কারণ মানব পাচারকারী চক্রের দৌরাত্ম্য এখানে ব্যাপক।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২৪ সালে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে প্রায় ২,৫০০ জনের মৃত্যু হয়েছে বা নিখোঁজ হয়েছেন।
মানব পাচার ও অবৈধ অভিবাসন বন্ধে আহ্বান
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই ঘটনার পর দেশটির নাগরিকদের অবৈধ পথে বিদেশে যাওয়ার বিষয়ে সতর্ক করেছে। এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘অবৈধ অভিবাসনের ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি, এটি শুধু প্রাণহানি ঘটায় না, বরং আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্রের শিকার হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়িয়ে দেয়। আমরা নাগরিকদের বৈধ উপায়ে বিদেশ গমনের পরামর্শ দিচ্ছি।’
বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থাও এই ঘটনাকে ‘ট্র্যাজেডি’ হিসেবে উল্লেখ করে অবৈধ অভিবাসন বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে। তারা বলছে, ইউরোপের দেশগুলোর উচিত নিরাপদ অভিবাসন নীতিমালা তৈরি করা, যাতে অভিবাসনপ্রত্যাশীরা নিরাপদে এবং আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে পারেন।
ইউরোপের প্রতিক্রিয়া ও উদ্ধার অভিযান
লিবিয়া উপকূলে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক নৌকাডুবির ঘটনায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ইইউর এক মুখপাত্র বলেন, ‘আমরা এই ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করছি এবং এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুরোধে লিবিয়া ও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে কাজ করছি।’
এদিকে, ইতালি, মাল্টা ও গ্রিসের কোস্টগার্ড বাহিনী সমুদ্রপথে অভিবাসন ঠেকাতে অতিরিক্ত টহল দিচ্ছে। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, কেবল টহল দিয়ে বা সীমান্ত বন্ধ করে এই সংকট সমাধান সম্ভব নয়, বরং অভিবাসন প্রত্যাশীদের জন্য নিরাপদ ও আইনানুগ পন্থা তৈরি করাই একমাত্র কার্যকর সমাধান।
নিহতদের পরিচয় শনাক্ত ও পরিবারকে সহায়তা
পাকিস্তান দূতাবাস নিহতদের পরিচয় শনাক্তের কাজ শুরু করেছে। ইতোমধ্যে কিছু মৃতদেহ শনাক্ত করা গেছে এবং নিহতদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারকে সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, অনেক পাকিস্তানি অভিবাসনপ্রত্যাশী দালালের খপ্পরে পড়ে প্রতারণার শিকার হন। এ কারণে তারা বিপজ্জনক পথ বেছে নিতে বাধ্য হন।
উদ্ধার কার্যক্রম অব্যাহত
লিবিয়ার কোস্টগার্ড ও উদ্ধারকারী সংস্থাগুলো নিখোঁজদের সন্ধানে তল্লাশি চালিয়ে যাচ্ছে। তবে সমুদ্রের প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে উদ্ধার অভিযান ব্যাহত হচ্ছে। স্থানীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এখনও নিখোঁজ ১০ জনের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লিবিয়া থেকে অবৈধ পথে ইউরোপে যাওয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে হলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। একইসঙ্গে, অভিবাসনপ্রত্যাশীদের জন্য নিরাপদ ও বৈধ অভিবাসন নীতিমালা প্রণয়ন করাও জরুরি।