বিশ্ব

ইরানের প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ানের যুক্তরাষ্ট্রের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন

ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান, আজ তেহরানে এক বক্তব্যে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার জন্য ওয়াশিংটনের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি সত্যিই আলোচনায় আগ্রহী থাকে, তাহলে কেন তারা ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে? এ সময় তিনি আরো বলেন, ইরান যুদ্ধ চায় না, কিন্তু বিদেশি চাপের কাছে নতি স্বীকার করবে না।

আজ, ১০ ফেব্রুয়ারি, ইরানে ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের ৪৬তম বার্ষিকী উপলক্ষে বিভিন্ন স্থানে মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। হাজারো মানুষ স্লোগান দেয়, ‘যুক্তরাষ্ট্রের মৃত্যু’। ইরানের জনগণ ও সরকার, বিশেষত শাসকগোষ্ঠী, যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ক্রমাগত অবস্থান নেয়ার পাশাপাশি দেশটির রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

১৯৭৯ সালের বিপ্লবের বার্ষিকী এবং এর প্রভাব

১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির শাসন পতিত হয়ে আছড়ে পড়ে এবং ইরানে ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পর থেকে, ইরান এবং যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক দিন দিন অবনতির দিকে চলে যায়। বিপ্লবের সময় থেকে, দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক প্রায় একেবারে বন্ধ হয়ে যায় এবং বরাবরই তাদের মধ্যে শক্তিশালী বৈরিতা বজায় থাকে।

ইরানে আজকের এই ঐতিহাসিক দিনে, বিপ্লবের ৪৬তম বার্ষিকীতে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধভাবে প্রতিবাদ জানায়। প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান এই ঘটনার মাধ্যমে ইরানী জনগণের কণ্ঠে কণ্ঠ মেলান এবং তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে দেন। তিনি বলেন, “আমরা কখনোই যুদ্ধের পক্ষে নই, কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।”

ট্রাম্পের সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগ নীতি

গত সপ্তাহে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের বিরুদ্ধে নতুন করে সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের নীতি শুরু করেছেন। এর অংশ হিসেবে, ট্রাম্প ইরানের জ্বালানি তেল রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর ফলে, ইরানকে ব্যাপক অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে পড়তে হচ্ছে। এই পদক্ষেপ, যা “ম্যাক্সিমাম প্রেশার” পলিসি নামে পরিচিত, ইরানকে তার পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করার জন্য চাপ দেওয়ার উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছে।

এদিকে, ট্রাম্প তার বক্তব্যে জানিয়েছেন যে, তিনি ইরানের সঙ্গে একটি নতুন পারমাণবিক শান্তিচুক্তি করতে চান। তিনি বলেছেন, “ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি না করে, তাহলে আমি তাদের সঙ্গে একটি নতুন চুক্তি করতে চাই, যা তাদের জন্য আরো সুবিধাজনক হবে।”

ইরানের অবস্থান: আলোচনা চাই, তবে শর্তসাপেক্ষ

প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান তার বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা শুরু করার ইরানের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। তবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ও কার্যক্রম নিয়ে গভীর সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “যদি যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই আলোচনার জন্য আন্তরিক হয়, তবে কেন তারা আমাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে?” পেজেশকিয়ান আরও যোগ করেন, “ইরান যুদ্ধ চায় না, কিন্তু আমাদের জনগণের ওপর চাপ তৈরি করার চেষ্টা করলে আমরা নতি স্বীকার করব না।”

পেজেশকিয়ান জানান, ইরানের জন্য সবসময় আলোচনা দরজা খোলা থাকে, তবে কোনো ধরনের চাপ বা নিষেধাজ্ঞা মেনে নেয়া হবে না। তিনি আরও বলেন, “আমরা আলোচনার জন্য প্রস্তুত, তবে আমাদের শর্ত থাকবে। সেসব শর্ত মানতে হবে।”

মিছিল এবং জনগণের একতা

আজ, বিপ্লবের বার্ষিকী উপলক্ষে তেহরানে হাজার হাজার মানুষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল বিরোধী স্লোগান দেয় এবং একতাবদ্ধভাবে তাদের প্রতিবাদ জানায়। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত ভিডিওতে দেখা গেছে, বিশাল সংখ্যক মানুষ ইরানী পতাকা এবং বিপ্লবী স্লোগান হাতে নিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছেন। এই মিছিলটি ইরানের শাসকগোষ্ঠীর জন্য একটি শক্তিশালী বার্তা হিসেবে কাজ করছে যে, ইরানী জনগণ তাদের সমর্থন নিয়ে সরকারকে তাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে সহায়তা করবে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগ নীতির কারণে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটছে। ইরানীয় সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে যে, যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক চুক্তি থেকে একতরফাভাবে বের হয়ে গেছে এবং ইরানের ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে, তাই তারা নতুন কোনো আলোচনা প্রক্রিয়ার জন্য প্রস্তুত নয়। তবে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে কিছু দেশ, বিশেষত ইউরোপীয় দেশগুলো, শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করার জন্য একযোগে কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছে।

সম্ভাব্য ভবিষ্যত পরিস্থিতি

এখন পর্যন্ত, ইরান এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে কম। যদিও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানকে নতুন চুক্তিতে নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন, তবে ইরান তার শর্তাবলীতে অটল থেকে যে কোনো ধরনের চাপ বা একতরফা পদক্ষেপ গ্রহণের বিরোধী অবস্থান নিয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে, ইরান কি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় বসবে, নাকি তারা তাদের নীতি এবং স্বার্থে দাঁড়িয়ে থাকবে, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে জোরালো আলোচনা চলছে। তবে, বর্তমান পরিস্থিতি কোনো দ্রুত পরিবর্তন আশা করা যাচ্ছে না।

উপসংহার

ইরানের প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ানের বক্তব্য এবং আজকের মিছিল বিশ্বে ইরানের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের মধ্যে আলোচনা চালানোর ইচ্ছা রয়েছে, তবে তা একতরফা চাপ বা নিষেধাজ্ঞার মধ্যে সম্ভব নয়। ইরান সরকার তার জনগণের সমর্থনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এবং কোনো ধরনের চাপের কাছে মাথা নত করবে না।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button