বাংলাদেশ

৮ দিন পর বাংলাদেশি যুবকের মরদেহ ফেরত দিলো বিএসএফ

Advertisement

চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার মাধবখালী সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)-এর গুলিতে নিহত বাংলাদেশি যুবক শহিদুল ইসলামের (৩৭) মরদেহ ৮ দিন পর বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর কাছে ফেরত দিয়েছে। শনিবার (৬ ডিসেম্বর) বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে উপজেলার চ্যাংখালী সীমান্তের শূন্য রেখায় দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে পতাকা বৈঠকের পর এই হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। নিহত শহিদুল ইসলাম ছিলেন দুই সন্তানের জনক। তাঁর মৃত্যুকে ঘিরে পরিবারের পক্ষ থেকে ‘ঘাস কাটতে গিয়ে হত্যা’ এবং বিএসএফের পক্ষ থেকে ‘মাদক কারবারি’ বলে দুই ধরনের বক্তব্য পাওয়া গেছে, যা সীমান্ত এলাকায় তীব্র আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

মরদেহ হস্তান্তর প্রক্রিয়া ও উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ

দীর্ঘ ৮ দিন পর নিহত শহিদুল ইসলামের মরদেহ ফেরত দেওয়া হয়। এই হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় চ্যাংখালী সীমান্তের শূন্য রেখায় বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে অনুষ্ঠিত পতাকা বৈঠকের পর। শনিবার (৬ ডিসেম্বর) বিকেল ৫টার দিকে।

বিজিবির পক্ষে গ্রহণ: মহেশপুর-৫৮ ব্যাটালিয়নের সহকারী পরিচালক মুন্সী ইমদাদ হোসেন আনুষ্ঠানিকভাবে মরদেহ গ্রহণ করেন।

অন্যান্য উপস্থিতি: এ সময় উপস্থিত ছিলেন জীবননগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মকবুল হোসেন, জীবননগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি-তদন্ত) রিপন কুমার দাস এবং দুই দেশের পুলিশ সদস্যসহ নিহতের স্বজনরা।

নিহতের পিতা নস্কর আলী ছেলের মরদেহ গ্রহণ করেন। এই দীর্ঘ অপেক্ষার পর মরদেহ ফেরত পাওয়ায় পরিবারের শোকের মাতম আরও বেড়েছে।

নিহত শহিদুল ইসলাম: পরিচয় ও পূর্বের ঘটনা

নিহত শহিদুল ইসলাম (৩৭) জীবননগর উপজেলার গয়েশপুর গ্রামের উত্তরপাড়ার নস্কর আলীর ছেলে। তিনি দুই সন্তানের জনক ছিলেন। গত ২৯ নভেম্বর বিকেলে মাধবখালী সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে তিনি নিহত হন।

পূর্ববর্তী বৈঠক: এর আগে গত ৩০ নভেম্বর একই সীমান্তে অনুষ্ঠিত পতাকা বৈঠকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিজিবির পক্ষ থেকে বিএসএফের কাছে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয় এবং দ্রুত লাশ ফেরতের দাবি তোলা হয়। দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া শেষে শনিবার তাঁর মরদেহ ফেরত দেওয়া হলো।

শহিদুল ইসলামের মৃত্যুকে ঘিরে পরিবার এবং বিএসএফের পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দুটি বক্তব্য পাওয়া গেছে:

নিহতের পরিবারের দাবি: ঘাস কাটতে গিয়ে হত্যা

নিহতের স্ত্রী নাসরিন আকতারের দাবি, তাঁর স্বামী শহিদুল ইসলাম সেদিন বিকেলে সীমান্তের দোয়ালের মাঠে গরুর জন্য ঘাস কাটতে গিয়েছিলেন। তিনি অভিযোগ করেন, এ সময় বিএসএফ সদস্যরা শহিদুলকে ধরে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে।

বিএসএফ ও স্থানীয় সূত্রের দাবি: মাদক কারবারী

অন্যদিকে, স্থানীয় সূত্র এবং বিএসএফের বরাতে বিজিবি জানায়, শহিদুল ইসলামসহ ৬-৭ জনের একটি দল মাদক আনতে ভারতের অভ্যন্তরে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছিল।

অনুপ্রবেশের স্থান: তারা মাধবখালী সীমান্তের ৭০ নম্বর মেইন পিলার থেকে প্রায় ২০০ গজ ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে ভারতের মাটিয়ারী ক্যাম্পের টহলরত বিএসএফ সদস্যদের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।

বিএসএফের অভিযোগ: অভিযোগ রয়েছে, এ সময় শহিদুল তাঁর হাতে থাকা হাঁসুয়া দিয়ে বিএসএফের ওপর চড়াও হন। একপর্যায়ে বিএসএফ গুলি ছুড়লে তিনি আহত হন এবং হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান।

এই দুই ধরনের বক্তব্য সীমান্ত হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিদ্যমান ধোঁয়াশা ও বিভ্রান্তিকে আরও বাড়িয়েছে।

আইনি ও কূটনৈতিক পদক্ষেপের পটভূমি

হত্যাকাণ্ডের পরদিন ভারতের কৃষ্ণনগর জেলা হাসপাতালে শহিদুলের লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয় এবং লাশটি হাসপাতালের মর্গে রাখা ছিল। ভারতের আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পরই মরদেহ ফেরত দেওয়া সম্ভব হলো।

বিজিবির পক্ষ থেকে পতাকা বৈঠকে কড়া প্রতিবাদ জানানো এবং দ্রুত লাশ ফেরতের দাবি তোলায় কূটনৈতিকভাবে এই ঘটনার গুরুত্ব বেড়েছে। যদিও বিএসএফের দাবি মেনে শহিদুলকে মাদক কারবারি বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, তবুও নিরস্ত্র বা ছোটখাটো অপরাধে যুক্ত ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করা ‘জিরো কিলিং’ নীতির স্পষ্ট লঙ্ঘন।

সীমান্ত হত্যার উদ্বেগ ও মানবাধিকারের প্রশ্ন

বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মীরা বারবার সীমান্তে বিএসএফের এই ধরনের হত্যাকাণ্ড নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, কোনো অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ থাকলেও, সীমান্তরক্ষী বাহিনীর উচিত অভিযুক্তকে গুলি না করে আটক করে আইনি প্রক্রিয়ায় সোপর্দ করা।

শহিদুল ইসলামের মৃত্যুর ঘটনা প্রমাণ করে যে, ভারত সরকার সীমান্তে ‘জিরো কিলিং’ নীতি কার্যকরে এখনও পুরোপুরি সফল হয়নি। এই ধরনের ঘটনা দুই বন্ধুপ্রতিম দেশের মধ্যেকার সম্পর্কেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং সীমান্ত এলাকার মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

ন্যায়বিচার ও সত্য উদঘাটনের দাবি

চুয়াডাঙ্গার সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত শহিদুল ইসলামের মরদেহ ৮ দিন পর ফেরত দেওয়া হলেও, এই হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত সত্য এখনও উদঘাটিত হয়নি। পরিবারের পক্ষ থেকে ‘ঘাস কাটতে গিয়ে হত্যা’ এবং বিএসএফের পক্ষ থেকে ‘মাদক কারবারি’—এই দুই রকম বক্তব্য প্রমাণ করে যে, এই ঘটনার নিরপেক্ষ ও পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রয়োজন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কূটনৈতিকভাবে কঠোর প্রতিবাদ অব্যাহত রাখা এবং ভবিষ্যতে সীমান্তে এই ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে চাপ সৃষ্টি করা জরুরি।

এম আর এম – ২৫১৭, Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button