খেলা

শতবছর পর অলিম্পিকে ফিরছে ক্রিকেট

Advertisement

বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন আসর অলিম্পিক গেমস। ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ নামে খ্যাত এই ক্রীড়া উৎসবের অপেক্ষায় প্রহর গোনেন সারা বিশ্বের কোটি ক্রীড়ামোদী। প্রতি চার বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হয় এই বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা, যেখানে বিশ্বের শত শত দেশ ক্রীড়া শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করে। তবে বিস্ময়কর হলেও সত্য, বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট দীর্ঘদিন ধরেই ছিল এই মহাযজ্ঞের বাইরে। অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটতে চলেছে। ১২৮ বছর পর আবারো অলিম্পিকের মাঠে গড়াবে ক্রিকেট বল। ২০২৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক গেমসে ফিরছে এই ঐতিহ্যবাহী খেলা। সম্প্রতি আয়োজক কমিটি ঘোষণা দিয়েছে, পোমোনা শহরের ফেয়ারগ্রাউন্ডেই অনুষ্ঠিত হবে ক্রিকেট ইভেন্টের সবগুলো ম্যাচ।

বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে ক্রিকেটের পরিচিতি নতুন কিছু নয়। শতবর্ষের বেশি সময় ধরে ক্রিকেট বিশ্বের নানা প্রান্তে জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করছে। টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি এই তিন ফরম্যাটের মাধ্যমে ক্রিকেট ভক্তদের হৃদয় জয় করে নিয়েছে। তবে, অলিম্পিক গেমসের ক্রীড়াপঞ্জিতে এই খেলার অন্তর্ভুক্তি ছিল না। এর পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকলেও, সবচেয়ে বড় কারণ ছিল আন্তর্জাতিক ক্রীড়া সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং ক্রিকেটের দীর্ঘ সময়কাল। তবে, সময়ের সঙ্গে বদলেছে অনেক কিছু। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) এবং আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি (আইওসি) এই ঐতিহ্যবাহী খেলাটিকে আবারও অলিম্পিকের মঞ্চে ফিরিয়ে আনতে সম্মত হয়েছে।

২০২৮ সালের লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক গেমসে ক্রিকেটের অন্তর্ভুক্তি ইতিমধ্যেই নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। আয়োজক কমিটি ‘এলএ২৮’ জানিয়েছে, বিশ্বব্যাপী টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের জনপ্রিয়তা বিবেচনা করেই এই সংস্করণটিকে বেছে নেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের পোমোনা শহরে অবস্থিত ফেয়ারগ্রাউন্ডে এই খেলার জন্য একটি অস্থায়ী স্টেডিয়াম গড়ে তোলা হবে। বিশ্বমানের এই স্টেডিয়ামে ক্রিকেটপ্রেমীরা উপভোগ করবেন বহু প্রতীক্ষিত অলিম্পিক ক্রিকেট ম্যাচ।

প্রাথমিকভাবে যদিও ক্রিকেট ম্যাচগুলো নিউইয়র্ক শহরে আয়োজনের পরিকল্পনা ছিল। কারণ, ২০২৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নিউইয়র্কে সফলভাবে আটটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তবে পরিবেশগত পরিস্থিতি, ভেন্যুর লজিস্টিকস এবং দর্শকদের অভিজ্ঞতা মূল্যায়ন শেষে আইওসি ও এলএ২৮ কমিটি শেষ পর্যন্ত পোমোনাকে চূড়ান্ত ভেন্যু হিসেবে নির্বাচন করে। ক্যালিফোর্নিয়ার আবহাওয়া, পরিবহন সুবিধা এবং গেমসের অন্যান্য ইভেন্টের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে আয়োজকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়।

২০২৮ অলিম্পিকের ক্রিকেট ইভেন্টে অংশ নেবে মোট ১২টি দল — ছয়টি পুরুষ দল এবং ছয়টি নারী দল। প্রতিটি দলের স্কোয়াডে থাকবে সর্বোচ্চ ১৫ জন করে খেলোয়াড়। সব মিলিয়ে ৯০ জন ক্রিকেটার এই আসরে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবেন। এই সংখ্যা সীমাবদ্ধ রাখার কারণ হিসেবে আইওসি উল্লেখ করেছে অলিম্পিক ভেন্যুগুলোর ধারণক্ষমতা এবং ক্রীড়া ইভেন্টের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি।

ক্রিকেট অলিম্পিকে ফিরছে বলে শুধু ভক্তরা নয়, খোদ ক্রিকেটাররাও আনন্দিত। আইসিসি এই বিষয়ে জানিয়েছে, এই অন্তর্ভুক্তি ক্রিকেটের বিশ্বব্যাপী প্রসারের জন্য একটি বড় সুযোগ। নতুন নতুন দেশে এই খেলার জনপ্রিয়তা বাড়ানোর পাশাপাশি অলিম্পিকের মতো একটি মঞ্চে ক্রিকেটারদের অংশগ্রহণ তাদের ক্যারিয়ারের মর্যাদাকে আরও সমৃদ্ধ করবে।

ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, অলিম্পিক গেমসে ক্রিকেটের উপস্থিতি অনেক পুরোনো হলেও সীমিত। ১৯০০ সালের প্যারিস অলিম্পিকে প্রথম এবং একমাত্রবারের মতো ক্রিকেট ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেবার অংশ নিয়েছিল মাত্র দুইটি দল — গ্রেট ব্রিটেন এবং ফ্রান্স। চূড়ান্ত ম্যাচে ব্রিটেন তাদের প্রতিপক্ষ ফ্রেঞ্চ অ্যাথলেটিক ক্লাব ইউনিয়নকে হারিয়ে স্বর্ণপদক জিতেছিল। এরপর ১৯৮৬ সালে এথেন্স অলিম্পিকের সময় ক্রিকেটকে আবারো অন্তর্ভুক্তির উদ্যোগ নেওয়া হলেও, প্রয়োজনীয় সংখ্যক দল না পাওয়ায় শেষ মুহূর্তে ইভেন্টটি বাতিল করা হয়।

২০২৮ সালে পোমোনায় অনুষ্ঠিতব্য অলিম্পিক গেমসে ক্রিকেটের অন্তর্ভুক্তি আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে নতুন যুগের সূচনা করবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ক্রিকেটের বিশ্বসংস্থা আইসিসি এক বিবৃতিতে জানায়, “অলিম্পিক গেমসে ক্রিকেট ফেরার এই সিদ্ধান্ত বিশ্বজুড়ে ক্রিকেটের গ্রহণযোগ্যতা এবং জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করবে। নতুন প্রজন্মের ক্রীড়াপ্রেমীরা এই খেলার সঙ্গে পরিচিত হবে এবং এর মাধ্যমে নতুন প্রতিভার উন্মোচন ঘটবে।”

ক্রিকেট অলিম্পিকে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় উপকৃত হবে শুধু খেলোয়াড়রা নয়, বরং অংশগ্রহণকারী দেশগুলোও। অলিম্পিকে পদক জয়ের সুযোগ মানেই দেশীয় ক্রীড়া উন্নয়নে নতুন দিগন্তের সূচনা। পাশাপাশি অলিম্পিকের মাধ্যমে গ্লোবাল ব্র্যান্ডিং এবং স্পনসরশিপ সুযোগও বাড়বে বহুগুণ। আইসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জিওফ অ্যালারডাইস বলেন, “ক্রিকেটের অলিম্পিকে অন্তর্ভুক্তি আমাদের দীর্ঘদিনের লক্ষ্য ছিল। অবশেষে সেই স্বপ্ন সফল হয়েছে। এর ফলে বিশ্বব্যাপী নতুন ভক্ত তৈরির পাশাপাশি ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ আরও উজ্জ্বল হবে।”

অন্যদিকে অলিম্পিক কর্তৃপক্ষও আশাবাদী যে, ক্রিকেটের অন্তর্ভুক্তি গেমসের দর্শকসংখ্যা বাড়াবে। বিশ্বে ক্রিকেটপ্রেমীর সংখ্যা প্রায় ২.৫ বিলিয়ন। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে এই খেলাটির বিশাল ভক্তবৃন্দ রয়েছে। এই অঞ্চলগুলোর দর্শকদের সরাসরি যুক্ত করার মাধ্যমে অলিম্পিকের বৈশ্বিক দর্শকবৃন্দেরও ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটবে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্রের মতো ক্রিকেটে তুলনামূলক নতুন বাজারে এই খেলাটি প্রতিষ্ঠিত করার এটিই হতে পারে সুবর্ণ সুযোগ। ইতোমধ্যেই মেজর লিগ ক্রিকেট (এমএলসি) নামের একটি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ শুরু হয়েছে আমেরিকায়, যা ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। অলিম্পিকে ক্রিকেট আয়োজনের মাধ্যমে এই বাজার আরও প্রসারিত হবে বলে আশা করছে আইসিসি।

সব মিলিয়ে বলা যায়, ১২৮ বছরের দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে ক্রিকেটের অলিম্পিক প্রত্যাবর্তন ক্রীড়াপ্রেমীদের জন্য এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। খেলাধুলার ইতিহাসে এই পদক্ষেপ ক্রিকেটের জন্য শুধু সম্মানজনক নয়, বরং বৈশ্বিক সম্প্রসারণের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। এখন অপেক্ষা শুধু ২০২৮ সালের সেই মাহেন্দ্রক্ষণের, যখন পোমোনার ফেয়ারগ্রাউন্ডে বাজবে ক্রিকেট বলের প্রথম শব্দ, গর্জে উঠবে স্টেডিয়াম আর নতুন ইতিহাস রচনা করবে এই প্রাচীন খেলা।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button