পাকিস্তানের রাজনীতিতে আবারও বড় ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) প্রতিষ্ঠাতা ইমরান খানকে ঘিরে নেওয়া নতুন সিদ্ধান্ত। কারাবন্দি ইমরান খানের সঙ্গে সব ধরনের সাক্ষাৎ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে পাকিস্তান সরকার। রাজনৈতিক দল, আইনজীবী, পরিবার—কেউই আর ইমরানের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না।
৬ ডিসেম্বর ২০২৫, শুক্রবার দেশটির তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার এক সংবাদ সম্মেলনে এই ঘোষণা দেন। তার বক্তব্যে সরাসরি আক্রমণের সুর ছিল, যেখানে তিনি ইমরান খানকে “যুদ্ধ উন্মাদনায় আক্রান্ত চরমপন্থি” বলেও মন্তব্য করেন। তার কিছুক্ষণ আগেই সেনাবাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী ইমরান খানের ব্যাপারে আরও কঠোর মন্তব্য করে তাকে “মানসিকভাবে অস্থিতিশীল” ও “জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি” হিসেবে বর্ণনা করেন।
এই দুই গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতির পরপরই পাকিস্তান সরকার হঠাৎ অত্যন্ত কঠোর নির্দেশনা দেয়—ইমরান খানের সঙ্গে আর কেউ সাক্ষাৎ করতে পারবে না, এবং জোর করে দেখা করতে চেষ্টা করলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সরকারের দাবি, ইমরান খান কারাগারে বসেই নানান উপায়ে “রাষ্ট্রবিরোধী এজেন্ডা” চালাচ্ছেন, যা দেশের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও রাজনৈতিক পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। তবে পিটিআই ও ইমরানের সমর্থকরা বলছেন, এটি “রাজনৈতিক প্রতিহিংসা” ছাড়া আর কিছুই নয়।
ইমরান খান: পাকিস্তানের রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত চরিত্র
ইমরান খান পাকিস্তানের রাজনীতিতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সবচেয়ে আলোচিত, প্রভাবশালী এবং একই সঙ্গে বিতর্কিত নেতা। ক্রিকেটের বিশ্বজয়ের পর রাজনীতিতে এসে তিনি দুর্নীতিবিরোধী সংগ্রামের নামে নিজেকে ‘পরিবর্তনের প্রতীক’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার পর ২০২২ সালে ক্ষমতাচ্যুত হন, আর এরপর থেকেই তার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা, গ্রেফতার ও রাজনৈতিক দমন শুরু হয়।
২০২৩ সালের ৯ মে পিটিআই কর্মীদের সহিংস বিক্ষোভের পর সেনাবাহিনী ইমরানের প্রতি অবস্থান আরও কড়া করে। তাকে ঘিরে রাষ্ট্রদ্রোহ, দুর্নীতি, গোপন তথ্য প্রকাশ, সরকারি উপহার আত্মসাৎসহ ডজনখানেক মামলা হয়। শুরু হয় পরিচিত পাকিস্তানি রাজনীতির এক ‘চিরাচরিত অধ্যায়’—বিরোধী নেতার ধ্বংসযজ্ঞ।
সরকারের অভিযোগ: কারাগারে বসে রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণা
পাকিস্তান সরকারের অভিযোগ, ইমরান খান কারাগার থেকে দলীয় নেতাদের মাধ্যমে নির্দেশনা পাঠাচ্ছেন, রাজনৈতিক পরিকল্পনা দিচ্ছেন, আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রভাব ফেলছেন এবং সরকারবিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছেন। তাদের ভাষায়, “একজন বন্দির এমন কার্যক্রম দেশকে অস্থিতিশীল করার প্রচেষ্টা।”
তথ্যমন্ত্রী তারার বলেন—
“ইমরান খান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তিনি কারাগার থেকেও অরাজকতা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তাকে কোনোভাবেই এই সুযোগ দেওয়া হবে না।”
সরকার আরও জানায়, নিরাপত্তা সংস্থা বিভিন্ন সময় তার সাক্ষাৎকারদানকারী ব্যক্তিদের যোগাযোগ ও ডিভাইস থেকে সন্দেহজনক তথ্য পেয়েছে। যদিও এসব তথ্য প্রকাশ্যে আনা হয়নি।
সেনাবাহিনীর বক্তব্য: ‘ইমরান মানসিকভাবে অসুস্থ’
এই ঘটনার সবচেয়ে বিতর্কিত অংশ ছিল পাকিস্তানের শক্তিধর সেনাবাহিনীর সরাসরি মন্তব্য। সেনাবাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী এক কথোপকথনে বলেন—
“ইমরান খান মানসিকভাবে অস্থির। তিনি নিজের ব্যর্থতাকে রঙচঙে গল্প বানিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করছেন। এমন একজন ব্যক্তিকে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া যায় না।”
এই মন্তব্য পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। বিরোধী দলগুলো অভিযোগ করে, সেনাবাহিনী আবারও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে সরাসরি হস্তক্ষেপ করছে।
পিটিআই-এর প্রতিক্রিয়া: ‘এটি ফ্যাসিবাদের চূড়ান্ত রূপ’
ইমরান খানের দল পিটিআই সরকারের এই সিদ্ধান্তকে “নির্বাচনের আগে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দমন” বলে আখ্যা দিয়েছে। পিটিআই নেতাদের দাবি—
- ইমরান খানকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে রাখা হচ্ছে যাতে তিনি দলের ভেতর যোগাযোগ করতে না পারেন।
- সরকার এবং সেনাবাহিনী আসন্ন নির্বাচনে পিটিআইকে দুর্বল করতে পরিকল্পিতভাবে ইমরান খানের রাজনৈতিক অধিকার কেটে ফেলছে।
- সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ করা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল।
দলীয় মুখপাত্র বলেন—
“ইমরান খান এখন রাজনৈতিক বন্দি। তাকে নীরব করে দিতে সরকার এমন ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু জনগণ তার সঙ্গে আছে।”
পরিবারের উদ্বেগ: ‘স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ঝুঁকিতে’
ইমরান খানের স্ত্রী বুশরা বিবির আইনি টিম সামাজিক মাধ্যমে জানিয়েছেন, পরিবারের পক্ষ থেকেও একমাস ধরে ইমরানের সঙ্গে দেখা করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। নতুন সিদ্ধান্তে তিনি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন বলে তারা আশঙ্কা করছেন।
পরিবারের দাবি, ইমরান খানের স্বাস্থ্য বিষয়ে নিয়মিত আপডেট পাওয়ার অধিকার তাদের রয়েছে। সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ হওয়ায় তা আর সম্ভব হবে না।
আইনজীবীদের অভিযোগ: ‘সংবিধান লঙ্ঘন’
ইমরান খানের আইনজীবীরা বলছেন, পাকিস্তানের সংবিধান কোনো বন্দির সঙ্গে আইনজীবীর সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা সরকারের হাতে দেয় না। তারা বলছেন—
- এটি বিচারপ্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ
- অভিযুক্ত ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার ক্ষুণ্ণ
- উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হবে
পাকিস্তানের মানবাধিকার সংগঠনগুলোও সরকারের সিদ্ধান্তকে অতিরিক্ত কঠোর বলে আখ্যা দিয়েছে।
কেন এই সিদ্ধান্ত? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতামত
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই সিদ্ধান্তের পেছনে কয়েকটি কারণ থাকতে পারে—
১. আসন্ন নির্বাচনের চাপ
পাকিস্তানে আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। পিটিআই হয়তো মাঠে দুর্বল, তবে জনসমর্থনে ইমরান এখনও জনপ্রিয়। তাকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করলে দল আরও দুর্বল হবে।
২. সেনাবাহিনী–ইমরান দ্বন্দ্ব চরমে
ইমরান খান বারবার সেনাবাহিনীকে তার রাজনৈতিক পতনের জন্য দায়ী করেছেন। সাম্প্রতিক মন্তব্যগুলো দেখায় এই সম্পর্ক আরও খারাপ হয়েছে।
৩. সরকারের অস্থিরতা
বর্তমান সরকার নানা ইস্যুতে চাপের মুখে। অর্থনৈতিক সংকট, ঋণ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক—সব মিলিয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ছে।
৪. পিটিআই ভাঙার প্রচেষ্টা
গত কয়েক বছরে পাকিস্তানে কোনো শক্তিশালী বিরোধী দল দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারেনি। ইতিহাস বলছে—বিরোধী দল শক্তিশালী হলে তাকে ভেঙে ফেলা হয়। পিটিআইও একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
কারাগারে ইমরান খানের অবস্থান: কী প্রকাশ পেয়েছে এতদিন?
ইমরান খানকে বর্তমানে রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা জেলে রাখা হয়েছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে যা জানা গেছে—
- তাকে সাধারণ বন্দির মতো রাখা হচ্ছে না
- বিশেষ নিরাপত্তা রয়েছে
- পড়াশোনা, ব্যায়াম, নামাজ—এই তিন কাজেই সময় কাটাচ্ছেন
- মাঝে মাঝে তাকে কোর্টে হাজিরার জন্য বিশেষ নিরাপত্তায় রওনা করানো হয়
তবে সরকার বলছে, ইমরান সাম্প্রতিক মাসগুলোতে কয়েকজন আইনজীবীর মাধ্যমে রাজনৈতিক নির্দেশনা পাঠিয়েছেন। যদিও এসব প্রমাণ এখনো প্রকাশ করা হয়নি।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: মানবাধিকার সংগঠনগুলোর উদ্বেগ
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য আর ইউরোপের কিছু মানবাধিকার সংগঠন আগে থেকেই ইমরানের গ্রেফতার ও বিচারপ্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ হিসেবে দেখছিল। নতুন সিদ্ধান্তে তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে—
- বন্দিকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন রাখা মানবাধিকার লঙ্ঘন
- রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চলছে
- ন্যায্য বিচার নিশ্চিত হবে না
তবে পাকিস্তান সরকার কোনো আন্তর্জাতিক চাপকে গুরুত্ব দিচ্ছে না, বরং বলছে, দেশের নিরাপত্তাই তাদের প্রথম লক্ষ্য।
পাকিস্তানের জনগণ কী ভাবছে?
পাকিস্তানের জনমত এখন বিভক্ত—
- অনেকে মনে করেন, ইমরান খান রাজনৈতিকভাবে বিপজ্জনক, তাকে বিচ্ছিন্ন করাই নিরাপদ
- আবার অনেকে মনে করেন, এটি “পুরনো পাকিস্তানি কৌশল”—যেখানে জনপ্রিয় নেতাকে হেয় করে রাজনৈতিক মাঠ সমতল করা হয়
- সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনার ঝড় চলছে
অনেকেই বলছেন, ইমরান খানের প্রতি এমন আচরণ তার জনপ্রিয়তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
সাক্ষাৎ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কি?
বর্তমানে সরকারের সুর অত্যন্ত কঠোর। তারা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে:
- কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাক্ষাৎ নয়
- আইনজীবীরাও আদালতের নির্দেশ ছাড়া দেখা করতে পারবেন না
- পরিবারকেও বিশেষ অনুমতি না দিলে সাক্ষাৎ দেওয়া হবে না
তাই, নিকট ভবিষ্যতে নিষেধাজ্ঞা উঠবে—এমন সম্ভাবনা খুবই কম।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ: কোথায় যাচ্ছে দেশ?
ইমরান খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ হওয়া শুধু একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়—এটি পাকিস্তানের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে আরও অশান্ত করে তুলেছে। হতে পারে—
- সামনে আরও দমন-পীড়ন দেখা যাবে
- পিটিআই ভাঙতে আরও চেষ্টা চলবে
- আদালত হয়তো সরকারের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে
- জনগণের ক্ষোভ আরও বাড়তে পারে
- আন্তর্জাতিক চাপ তীব্র হতে পারে
বিশ্লেষকদের মতে, পাকিস্তানের রাজনীতিতে শান্তি ও স্থিতি ফিরতে অনেক সময় লাগবে।
ইমরান খান পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক অনিবার্য শক্তি—সমর্থকরা তাকে নায়ক মনে করেন, আর বিরোধীরা তাকে হুমকি বলে মনে করেন। সরকার ও সেনাবাহিনী তার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।
সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এখন প্রশ্ন—পাকিস্তান কি আরও অস্থিরতার দিকে এগোচ্ছে, নাকি একটি নতুন ক্ষমতার কাঠামো তৈরি হচ্ছে?
সেসব প্রশ্নের উত্তর সময়ই দেবে। তবে বর্তমানে পাকিস্তান গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে, আর ইমরান খান সেই অনিশ্চয়তার কেন্দ্রবিন্দুতে।
MAH – 14153 I Signalbd.com



