ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে কেন্দ্র করে তৈরি একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা–নির্ভর (এআই) ভিডিও দেশটির রাজনীতিতে চরম বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। ভিডিওতে দেখা যায়—মোদি আন্তর্জাতিক এক সম্মেলনের ভেতর চা বিক্রি করছেন, হাতে কেটলি, অন্য হাতে তিনটি গ্লাস। ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয় ব্যাপক আলোচনা, সমালোচনা, পাল্টা সমালোচনা। ভিডিও শেয়ার করার জন্য সবচেয়ে বেশি সমালোচনার মুখে পড়েন কংগ্রেস নেত্রী রাঘিনি নায়ক।
সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি জানায়, পার্লামেন্টে শীতকালীন অধিবেশন চলার সময় এমন ভিডিও প্রকাশ পাওয়ায় রাজনৈতিক উত্তাপ আরও বেড়েছে। সংসদের অভ্যন্তরে যেমন নানা ইস্যুতে তীব্র বাকবিতণ্ডা চলছে, তেমনি বাইরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই এআই ভিডিওকে কেন্দ্র করে চলছে রাজনৈতিক যুদ্ধে নতুন অধ্যায়।
এআই ভিডিওতে কী দেখা গেছে?
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি ভিডিওটিতে দেখা যায়—
- মোদির হাতে একটি চায়ের কেটলি
- অন্য হাতে তিনটি গ্লাস
- তিনি যেন কোনো আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ভেতর দাঁড়িয়ে আছেন
- উচ্চস্বরে ডাকছেন—“এই চা!”
ভিডিওটি প্রথম দেখলে অনেকেই মনে করেন এটি বাস্তব। কিন্তু পরবর্তীতে বোঝা যায়, এটি সম্পূর্ণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি। ভিডিওতে মোদির উপস্থিতি দেখানো হলেও পরিবেশ, আলো, শব্দ—সবকিছুর মধ্যেই এআই–এর প্রযুক্তিগত ছাপ স্পষ্ট।
এই ধরনের ভিডিও কোনোভাবেই বাস্তব নয়, বরং ডিজিটাল ম্যানিপুলেশনের মাধ্যমে জনমত প্রভাবিত করার চেষ্টা বলেই অনেকেই মনে করছেন।
মোদির চা বিক্রির অতীত—রাজনীতিতে দীর্ঘদিনের আলোচনার বিষয়
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বহুবার নিজেই বলেছেন, তিনি ছোটবেলায় বাবা দামোদরদাস মোদির সঙ্গে গুজরাটের ভাদনগর রেলস্টেশনে চা বিক্রি করতেন। তাঁর রাজনৈতিক সফলতার গল্পে এই বিষয়টি সবসময়ই আলোচিত।
মোদির সমর্থকেরা তাঁর এই অতীতকে তুলে ধরেন ‘‘সাধারণ মানুষের সন্তান’’ হিসেবে তাঁর সাফল্যের প্রতীক হিসেবে। অন্যদিকে, কংগ্রেসসহ বিরোধী দলগুলো বহুবার এই প্রসঙ্গ নিয়ে ব্যঙ্গ–বিদ্রূপ করেছে।
অনেক বিশ্লেষকের মতে, ভারতের রাজনীতিতে ‘‘চা ওয়ালা’’ পরিচয়টি এখন এক ধরনের রাজনৈতিক উপকরণে পরিণত হয়েছে। আর সেই কারণেই এই এআই ভিডিও প্রকাশ পাওয়ার পর বিষয়টি আরও সংবেদনশীল আকার ধারণ করেছে।
কংগ্রেস নেত্রীর ভিডিও শেয়ারের পর বিজেপির তীব্র প্রতিক্রিয়া
কংগ্রেস নেত্রী রাঘিনি নায়ক তাঁর এক্স (টুইটার) অ্যাকাউন্টে ভিডিওটি শেয়ার করার পরই শুরু হয় বিতর্ক। ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিজেপি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানায়।
বিজেপি মুখপাত্র শেহজাদ পুনওয়ালা বলেন—
“রেনুকা চৌধুরী যখন সংসদকে অসম্মান করেছিলেন, এখন রাঘিনি নায়ক প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর ‘চা ওয়ালা’ অতীত নিয়ে ব্যঙ্গ করছেন। কংগ্রেস বারবার সাধারণ মানুষের সন্তান মোদিকে অপমান করে আসছে। তারা তাঁর অতীতকে ১৫০ বারেরও বেশি তাচ্ছিল্য করেছে। এমনকি তাঁর মাকেও রাজনৈতিক আক্রমণের শিকার করা হয়েছে। দেশের মানুষ কংগ্রেসকে ক্ষমা করবে না।”
শেহজাদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট—বিজেপি এটিকে শুধুমাত্র একটি ভিডিও–স্ক্যান্ডাল হিসেবে দেখছে না; তারা এটিকে কংগ্রেসের ‘‘নিয়মিত অপমানের ধারাবাহিকতা’’ বলে মনে করছে।
কংগ্রেসের ব্যাখ্যা: ‘এটি কেবল একটি ব্যঙ্গাত্মক শেয়ার’
কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানায়, রাঘিনি নায়ক ভিডিওটি ব্যঙ্গাত্মক একটি কনটেন্ট হিসেবে শেয়ার করেছিলেন। তাদের দাবি, ভিডিওটি শেয়ার করে সরাসরি মোদিকে অপমান করা হয়নি, বরং বর্তমান সরকারের নীতির ব্যঙ্গচিত্র হিসেবে এটি পোস্ট করা হয়েছিল।
তবে বিজেপির অভিযোগ—এই ব্যঙ্গচিত্র ‘‘রাজনৈতিক ইচ্ছাকৃত অপমান’’—এবং এটি সংসদের শীতকালীন অধিবেশনের সময় অপ্রয়োজনীয় উত্তেজনা ছড়ানোর উদ্দেশ্যেই ছড়ানো হয়েছে।
এআই ভিডিও–বিতর্ক: ভবিষ্যৎ নির্বাচনী রাজনীতিতে নতুন ঝুঁকি
বিশ্বজুড়েই এখন বড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের বিরুদ্ধে এআই–নির্ভর ভুয়া ভিডিও তৈরি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া—সবই এর শিকার। ভারতও ব্যতিক্রম নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন—
- এআই ভিডিও রাজনৈতিক বিভ্রান্তি বাড়াবে
- জনমতকে ভুল পথে পরিচালিত করবে
- নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে
- ভুয়া তথ্য সনাক্ত করা আরও কঠিন হবে
ভারতের ২০২৬ সালের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি রাজ্য নির্বাচন সামনে রেখে এ ধরনের ভিডিও ছড়িয়ে পড়া বেশ উদ্বেগজনক বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।
এআই–এর অপব্যবহার রোধে কী করা উচিত? বিশেষজ্ঞদের মতামত
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি শক্তিশালী নীতিমালা ছাড়া ডিজিটাল যুগে মানুষকে বিভ্রান্ত করা সহজ হবে।
তাদের মতে—
- ভুয়া ভিডিও শনাক্ত করতে কঠোর আইন প্রয়োজন
- ডিপফেক তৈরিতে ব্যবহৃত প্ল্যাটফর্মগুলোকে দায় নিতে হবে
- সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফ্যাক্ট–চেকিং বাধ্যতামূলক করা উচিত
- রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত এসব ভিডিও ব্যবহার না করার অঙ্গীকার করা
অনেক দেশ ইতোমধ্যে ডিপফেক ভিডিও নিয়ন্ত্রণে আইন করেছে। ভারতেও এ নিয়ে আলোচনা চলছে, তবে এখনো কঠোর আইন প্রণয়ন হয়নি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উত্তাল বিতর্ক
এআই ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর একদল মানুষ কংগ্রেসকে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছে। তারা মনে করছেন, রাজনৈতিক ব্যঙ্গ কখনোই ব্যক্তিগত সম্মানহানিতে রূপ নেওয়া উচিত নয়।
অন্যদিকে, কংগ্রেসপন্থী একটি অংশ বলছে—
- রাজনৈতিক সমালোচনা বা ব্যঙ্গ গণতন্ত্রের অংশ
- মোদির অতীত তিনি নিজেই রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছেন
- তাই এ নিয়ে ব্যঙ্গ করা রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হিসেবে গ্রহণযোগ্য
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ড করতে থাকে—
- #AIvideo
- #Modi
- #CongressVsBJP
- #DeepfakePolitics
- #FakeVideoDebate
ডিজিটাল যুগে ভুয়া ভিডিও নিয়ে যে রাজনৈতিক মেরুকরণ তৈরি হতে পারে—এই বিতর্ক তারই একটি বড় উদাহরণ।
মোদির চা বিক্রির গল্প: গর্ব? নাকি রাজনৈতিক অস্ত্র?
মোদির অতীত নিয়ে বড় বিতর্ক বহুবার উঠেছে। কেউ বলেন—
- এটি কঠোর সংগ্রামের প্রতীক
- সাধারণ মানুষের জীবনের প্রতিচ্ছবি
- শৈশবের কষ্ট তাঁর নেতৃত্বকে কঠিন করেছে
আবার কেউ মনে করেন—
- এই গল্প রাজনীতিতে অতিরিক্তভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে
- ‘চা ওয়ালা’ পরিচয়কে অতিরঞ্জিত করা হয়েছে
- সাধারণ মানুষের আবেগকে প্রভাবিত করার জন্য গল্পটি ব্যবহার করা হচ্ছে
এজন্য বিরোধী দলগুলো কখনো কখনো এই বিষয়টিকে ব্যঙ্গ করে। কিন্তু তাতে রাজনৈতিক উত্তেজনা আরও বাড়ে।
ফেক ভিডিও কীভাবে শনাক্ত করা যায়?
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ—
- মুখের গতিবিধির অস্বাভাবিকতা খেয়াল করুন
- পটভূমির আলো ও ছায়া পরীক্ষা করুন
- অডিও–ভিডিও সিঙ্ক ঠিক আছে কি না দেখুন
- বিশ্বাসযোগ্য সংবাদমাধ্যমে ভিডিওর সত্যতা যাচাই করুন
এমন ভিডিও সাধারণত আবেগকে প্রভাবিত করে দ্রুত ভাইরাল হয়।
রাজনৈতিক ব্যবহারের ঊর্ধ্বে গিয়ে এআই–এর ঝুঁকি নিয়ে সচেতন হওয়া জরুরি
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন—
‘‘এআই যদি অনিয়ন্ত্রিতভাবে রাজনৈতিক প্রচারণায় ব্যবহার হয়, তাহলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বিপদের মুখে পড়বে।’’
ডিপফেক প্রযুক্তিতে এখন একজনের মুখ অন্যের শরীরে বসানো অত্যন্ত সহজ। এমনকি কণ্ঠও নকল করা যায়। ফলে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিকে নিয়ে অশ্লীল, আপত্তিকর বা বিভ্রান্তিকর ভিডিও তৈরি করা এখন কয়েক মিনিটের ব্যাপার।
ভারতের মতো বিশাল গণতন্ত্রে যেখানে নির্বাচনে কোটি কোটি ভোটার অংশ নেয়—সেখানে এ ধরনের ভিডিও জনমতকে ভুল পথে পরিচালিত করতে পারে।
সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু কেন কংগ্রেস?
বিজেপি দাবি করছে—
- কংগ্রেস ইচ্ছাকৃতভাবে মোদিকে অপমান করতে ভিডিওটি ছড়িয়েছে
- মোদির অতীতকে বারবার ব্যঙ্গ করে তারা জনগণের সহানুভূতিকে আঘাত করছে
- এটি ‘‘সংগঠিত রাজনৈতিক অপপ্রচার’’
কংগ্রেস পাল্টা বলছে—
- ভিডিওটি তারা তৈরি করেনি
- একটি ব্যঙ্গাত্মক কনটেন্ট শেয়ার করাই ছিল উদ্দেশ্য
- বিজেপি বিষয়টিকে অতিরঞ্জিত করছে
এই দ্বন্দ্বের মধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় শুরু হয়েছে নতুন রাজনৈতিক তরঙ্গ।
বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করছে শীতকালীন অধিবেশন
ভারতের শীতকালীন অধিবেশন সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ আইন, অর্থনীতি, নির্বাচন–পূর্ব আলোচনা এবং কূটনীতিক ইস্যুতে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে এমন ভিডিও ভাইরাল হওয়ায়—
- আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু বদলে গেছে
- সংসদের ভেতর–বাইরে উত্তেজনা বেড়েছে
- বিরোধী দল–সরকার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়েছে
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এটি হয়তো ২০২৬ সালের নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ হিসেবেও দেখা যেতে পারে।
ভারতের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ: ডিজিটাল রাজনীতির নতুন যুগ
এখন প্রশ্ন—এআই–নির্ভর ভিডিও কি ভবিষ্যতের প্রধান রাজনৈতিক অস্ত্র হয়ে উঠবে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের উত্তর—
হ্যাঁ।
ডিজিটাল যুগে—
- প্রচারণা
- সমালোচনা
- আক্রমণ
- বিভ্রান্তি
সবই অনলাইনেই বেশি ঘটছে। আর এআই সেই প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করছে।
তাই মোদির এআই ভিডিও বিতর্ক শুধু আজকের ঘটনা নয়—এটি ভবিষ্যতের ডিজিটাল রাজনৈতিক যুদ্ধের ইঙ্গিত।
মোদি–বিষয়ক এই এআই ভিডিও ভারতের রাজনৈতিক জগতে এক নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এটি শুধু একটি ভিডিও নয়—এটি দেখাচ্ছে ভারতসহ বিশ্ব কত দ্রুত ডিজিটাল বিভ্রান্তির ঝুঁকির দিকে এগোচ্ছে।
রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দল, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, সংবাদমাধ্যম—সবারই দায়িত্ব রয়েছে এমন ভুয়া কনটেন্ট শনাক্ত করা এবং নাগরিকদের সঠিক তথ্য পৌঁছে দেওয়া।
মোদি সত্যিই চা বিক্রি করতেন—এ গল্প ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের অংশ। কিন্তু সেই অতীতকে ব্যঙ্গ করতে এআই ব্যবহার—এটি নতুন বিতর্কের দরজা খুলেছে। আর এই বিতর্কই প্রমাণ করে—ডিজিটাল যুগে সত্য আর মিথ্যার সীমানা ক্রমেই ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।
MAH – 14111 I Signalbd.com



