পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমের খাইবার পাখতুনখোয়া (কেপি) প্রদেশের বান্নু জেলায় মিরানশাহের সহকারী কমিশনার শাহ ওয়ালি’র গাড়ি লক্ষ্য করে অতর্কিত সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। মঙ্গলবার (২ ডিসেম্বর) চালানো এই হামলায় দুই পুলিশ সদস্যসহ মোট তিনজন নিহত হয়েছেন। এছাড়াও, হামলায় আহত হয়েছেন আরও দুই পুলিশ সদস্য। এই সন্ত্রাসী হামলাটি বান্নু ক্যান্ট থানা এলাকার মধ্যেই চালানো হয়। এই ঘটনার পরপরই বান্নু ও সংলগ্ন এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সহকারী কমিশনার শাহ ওয়ালিও হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন বলে কিছু প্রতিবেদনে দাবি করা হলেও, এই তথ্যটি আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করেনি কর্তৃপক্ষ। এই হামলাটি কেপি প্রদেশে বেড়ে চলা সন্ত্রাসী তৎপরতার সর্বশেষ উদাহরণ।
হামলার বিস্তারিত: নিহত ৩ ও আহত ২
আঞ্চলিক পুলিশ কর্মকর্তার (আরপিও) মুখপাত্র নওয়াজ পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমকে এই সন্ত্রাসী হামলার তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, সহকারী কমিশনার শাহ ওয়ালির গাড়ি বান্নু ক্যান্ট থানা এলাকার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় সন্ত্রাসীরা অতর্কিতভাবে হামলা চালায়। এই হামলার লক্ষ্য ছিলেন সহকারী কমিশনার শাহ ওয়ালি।
নওয়াজ জানান, ‘হামলায় দুই কনস্টেবল এবং এক স্থানীয় নাগরিক শহীদ হয়েছেন। এতে আহত হন আরও দুই পুলিশ সদস্য।’ প্রাথমিক প্রতিবেদনে সহকারী কমিশনারের মৃত্যু নিয়ে জল্পনা উঠলেও, এই রিপোর্ট তৈরি করা পর্যন্ত তা আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত হয়নি। এই ধরনের অতর্কিত হামলা পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী এবং স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের জন্য একটি বড় ঝুঁকি তৈরি করছে। বান্নু ক্যান্ট এলাকাটি মিরানশাহ উত্তর ওয়াজিরিস্তানের প্রশাসনিক সদর দপ্তরের সংলগ্ন।
আক্রমণের লক্ষ্য: প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ওপর হামলা
সহকারী কমিশনার শাহ ওয়ালি’র গাড়ি লক্ষ্য করে চালানো এই হামলা প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ওপর সন্ত্রাসীদের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু হওয়ার ইঙ্গিত দেয়। সহকারী কমিশনার পদাধিকারবলে স্থানীয় প্রশাসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা। তাঁকে লক্ষ্য করে চালানো হামলা এই অঞ্চলে সরকারি ক্ষমতা ও প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করার একটি প্রচেষ্টা।
সাধারণত, স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সন্ত্রাসীদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে থাকেন। এই হামলাটি বানিল ও ওয়াজিরিস্তানের মতো স্পর্শকাতর অঞ্চলে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং আতঙ্ক সৃষ্টি করবে। এই অঞ্চলে সন্ত্রাস দমনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ও পুলিশি কার্যক্রম ব্যাহত করার উদ্দেশ্যেই এই হামলা চালানো হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
টিটিপি’র যুদ্ধবিরতি বাতিল ও সহিংসতা বৃদ্ধি
পাকিস্তানে সম্প্রতি সন্ত্রাসী হামলা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাওয়ার পেছনে রয়েছে তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি)। ২০২২ সালে টিটিপি দেশটির সরকারের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি বাতিল করার পর থেকেই সহিংসতা বাড়তে শুরু করে। যুদ্ধবিরতি বাতিলের পর টিটিপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে তারা নিরাপত্তা বাহিনী, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ওপর নতুন করে হামলা চালাবে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এই সন্ত্রাসী তৎপরতা বিশেষত খাইবার পাখতুনখোয়া (কেপি) ও বেলুচিস্তান প্রদেশে চরম আকার ধারণ করেছে। বান্নুতে এই হামলা এমন এক সময় ঘটল, যখন এর ঠিক একদিন আগেই লাক্কি মারওয়াত ও বান্নু জেলায় আত্মঘাতী বোমা হামলা এবং বন্দুক হামলায় দুই পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছিলেন। এই ধারাবাহিক হামলা প্রমাণ করে যে, টিটিপি তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর চাপ বাড়াচ্ছে।
সন্ত্রাসবাদের ঢেউ: কেপি ও বেলুচিস্তানে দুর্বলতা
খাইবার পাখতুনখোয়া এবং বেলুচিস্তানে সন্ত্রাসী হামলার মাত্রা বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে টিটিপি’র পুনর্গঠন এবং এই অঞ্চলে তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা। আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকাগুলোতে টিটিপি-এর মতো গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কেপি প্রদেশের এই অংশে নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি এবং গোয়েন্দা কার্যক্রমের ক্ষেত্রে কিছু দুর্বলতা থাকতে পারে। বান্নু এবং উত্তর ওয়াজিরিস্তান দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাসবাদ এবং উপজাতীয় সংঘাতের কেন্দ্র ছিল। এই অঞ্চলের জটিল ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি টিটিপি-এর মতো গোষ্ঠীগুলোকে হামলায় সুবিধা দিচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে এই অঞ্চলে সন্ত্রাস দমনে আরও কঠোর ও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
সহকারী কমিশনারের গাড়ি লক্ষ্য করে চালানো এই হামলায় তিনজন নিহত হওয়ায় পাকিস্তানের সরকার এবং রাজনৈতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষমতাসীন দল এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং সন্ত্রাসীদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছে। এই ধরনের হামলা দেশের অভ্যন্তরে নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ানোর আশঙ্কা তৈরি করে।
আন্তর্জাতিক মহলও পাকিস্তানের এই অঞ্চলে সন্ত্রাসী হামলার বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সন্ত্রাস দমনে পাকিস্তানকে আরও কার্যকর ভূমিকা নেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ আসতে পারে। সন্ত্রাসবাদ দমনে পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনকে সমন্বিত কৌশল গ্রহণ করতে হবে।
নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর চাপ ও ন্যায়বিচারের দাবি
খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের বান্নুতে সহকারী কমিশনারের গাড়িতে অতর্কিত হামলা এবং তিনজনের নিহত হওয়ার ঘটনা পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর টিটিপি’র ক্রমাগত চাপকেই নির্দেশ করে। সহকারী কমিশনার শাহ ওয়ালি বেঁচে আছেন কিনা, সে বিষয়ে দ্রুত আনুষ্ঠানিক তথ্য প্রকাশ করা জরুরি। নিহত পুলিশ সদস্য ও স্থানীয় নাগরিকের পরিবারকে ন্যায়বিচার এবং সন্ত্রাস দমনে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা এখন সরকারের জন্য একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ। এই অঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হলে টিটিপি’র মতো নিষিদ্ধ গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ এবং কার্যকর অভিযান চালানো ছাড়া বিকল্প নেই।
এম আর এম – ২৪৬১, Signalbd.com



