বাংলাদেশ

ডেঙ্গুতে আরও ২ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৭০৫

Advertisement

বাংলাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি এখনও উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে এডিস মশাবাহিত এই রোগে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ৭০৫ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন।

সোমবার (২৪ নভেম্বর) স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়। নতুন ৭০৫ জন রোগীর মধ্যে ঢাকা সিটি করপোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) বাইরে ৪৫৭ জন এবং ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকায় ২৪৮ জন ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৬৬ জনে। বছরজুড়ে ডেঙ্গুর এই অব্যাহত প্রকোপ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে।

সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান ও আক্রান্তের হার

গত ২৪ ঘণ্টার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ডেঙ্গু এখন আর শুধু ঢাকা শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং সারাদেশে এর প্রকোপ বেড়েছে।

নতুন রোগীর সংখ্যা: গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৭০৫ জনের মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ১৭১ জন এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৭৭ জনসহ মোট ২৪৮ জন রোগী ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকায় ভর্তি হয়েছেন।

বিভাগীয় চিত্র: ঢাকা শহরের বাইরে অন্যান্য বিভাগেও ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা উদ্বেগজনক। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১১৬ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১৩৭ জন, বরিশাল বিভাগে ৬২ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৫৩ জন, রাজশাহী বিভাগে ৩৪ জন, খুলনা বিভাগে ৩৪ জন, রংপুর বিভাগে ৫ জন এবং সিলেট বিভাগে ১৬ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন।

লিঙ্গভিত্তিক তথ্য: চলতি বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে ৬২ দশমিক তিন শতাংশ পুরুষ এবং ৩৭ দশমিক সাত শতাংশ নারী।

চলতি বছরের সামগ্রিক ভয়াবহতা

চলতি বছরের ডেঙ্গু পরিস্থিতি বাংলাদেশে এর আগের বছরগুলোর তুলনায় ভিন্ন এবং আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

মোট আক্রান্তের সংখ্যা: চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৯০ হাজার ৯৬৯ জন। এদের মধ্যে চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন ৮৮ হাজার ২৫৮ জন।

মহামারির আকার: ডেঙ্গু এখন আর শুধুমাত্র বর্ষা মৌসুমের রোগ নয়, বরং এটি সারা বছর ধরে চলতে থাকা একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যায় পরিণত হয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ড. আতিকুর রহমান বলেন, “ডেঙ্গু এখন সারা বছরই হচ্ছে। বৃষ্টি শুরু হলে এটা বাড়ছে।” এই পরিবর্তন স্বাস্থ্যখাতের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে।

মৃত্যুর সংখ্যা: চলতি বছরের ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা (৩৬৬ জন) এর আগের বছরগুলোর তুলনায় যথেষ্ট বেশি। যদিও ২০২৩ সালে আক্রান্তের সংখ্যা (৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন) এবং মৃতের সংখ্যা (১ হাজার ৭৯ জন) সর্বোচ্চ ছিল, তবুও এই বছরও ডেঙ্গুর প্রাণঘাতী রূপ বজায় রয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ: মশার বিস্তার ও প্রতিরোধে ঘাটতি

স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞ ও কীটতত্ত্ববিদরা ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন।

মশা নিধনে দুর্বলতা: কীটতত্ত্ববিদ ড. মনজুর চৌধুরী মনে করেন, মশানিধনে শুধু জেল-জরিমানা আর জনসচেতনতা বাড়িয়ে কাজ হবে না। তাঁর মতে, মশা নিয়ন্ত্রণে সফলতা আনতে হলে সঠিকভাবে জরিপ চালিয়ে দক্ষ জনবল দিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। মশা নিধনের ওষুধ ও প্রয়োগ পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

চিকিৎসা পদ্ধতির পরিবর্তন: বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর ধরনও আগের চেয়ে পাল্টেছে। এখন ডেঙ্গু হেমোরেজিক বা শক সিনড্রোমের পাশাপাশি অনেক রোগী অন্যান্য জটিলতা নিয়েও আসছেন। এই কারণে ডেঙ্গুর চিকিৎসা পদ্ধতিতেও আরও আধুনিকায়ন আনা জরুরি।

সচেতনতার গুরুত্ব: ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশা নিরোধক ওষুধ ব্যবহারের পাশাপাশি সব জায়গায় ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে। বিশেষ করে বাসাবাড়ির ভেতরে ও আশেপাশে জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে এডিস মশার বংশ বিস্তার রোধে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।

প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যতের কর্মপরিকল্পনা

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সিটি করপোরেশনকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

সিটি করপোরেশনের ভূমিকা: ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করলেও, আক্রান্তের সংখ্যা প্রমাণ করে যে এই অভিযানগুলো এখনও কার্যকর ফল দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। মশা প্রজনন স্থান ধ্বংসে আরও কঠোর পদক্ষেপ ও নিয়মিত তদারকি দরকার।

বছরব্যাপী মশা নিয়ন্ত্রণ: যেহেতু ডেঙ্গু এখন সারা বছর হচ্ছে, তাই মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকেও বছরব্যাপী করতে হবে। শুধু বর্ষা মৌসুমের আগে নয়, বরং সারা বছর ধরে মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করার উদ্যোগ নিতে হবে।

ডেটা বিশ্লেষণ: কোন এলাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি এবং কোন ধরনের মশা বেশি বিস্তার লাভ করছে, সেই বিষয়ে সঠিক ডেটা বিশ্লেষণ করে এলাকাভিত্তিক পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ড. আতিকুর রহমান: “ডেঙ্গু এখন সারা বছরই হচ্ছে। বৃষ্টি শুরু হলে এটা বাড়ছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশা নিরোধক ওষুধ ব্যবহারের পাশাপাশি সব জায়গায় প্রচার চালাতে হবে। একইসঙ্গে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।”

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সামাজিক দায়িত্ব

গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আরও ২ জনের মৃত্যু এবং ৭০৫ জন নতুন রোগীর ভর্তি বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য খাতের জন্য এক গভীর উদ্বেগের কারণ। চলতি বছরে আক্রান্ত ও মৃত্যুর যে পরিসংখ্যান দেখা যাচ্ছে, তা ইঙ্গিত করে যে এই রোগটি এখন একটি স্থায়ী মহামারির দিকে এগোচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধুমাত্র সরকারের বা সিটি করপোরেশনের একক উদ্যোগে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। মশা নিধনে সঠিক জরিপ, কার্যকর ওষুধ প্রয়োগ এবং দক্ষ জনবল নিয়োগের পাশাপাশি ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতা অত্যন্ত জরুরি। নিজ নিজ বাড়ির আঙ্গিনা, টবে জমে থাকা পানি পরিষ্কারের মাধ্যমে এডিস মশার বংশবিস্তার রোধে প্রতিটি নাগরিককে এগিয়ে আসতে হবে। ডেঙ্গুর এই লাগাম টেনে ধরতে না পারলে আগামী বছরগুলোতে এটি আরও বড় স্বাস্থ্য সংকট সৃষ্টি করতে পারে।

এম আর এম – ২৩৫৬,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button