বিশ্ব

স্পেনে দাবানলে ৫শ’ সৈন্য মোতায়েন, অব্যাহত তাপদাহ ও শতাধিক পরিবার বিপদে

Advertisement

স্পেনের বিভিন্ন অঞ্চলে সম্প্রতি শুরু হওয়া তীব্র দাবানল মোকাবিলায় দেশজুড়ে মিলিটারি এমার্জেন্সি ইউনিট আরও ৫০০ সৈন্য মোতায়েন করেছে। এই পদক্ষেপ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আগুন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে এবং ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার জন্য নেওয়া হয়েছে।

স্থানীয় সময় রোববার (১৭ আগস্ট) এক সংবাদ সম্মেলনে স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ বলেন, “আগামী দিনগুলোও চ্যালেঞ্জপূর্ণ হবে। দুর্ভাগ্যবশত আবহাওয়া আমাদের পক্ষেই নেই। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছি, কিন্তু পরিস্থিতি খুবই জটিল।”

প্রধানমন্ত্রী জানান, এই মুহূর্তে দাবানল মোকাবিলায় মোতায়েন করা সৈন্যের মোট সংখ্যা ১,৯০০-এ পৌঁছেছে। এরা মূলত আগুন নেভানো, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ত্যাগ করা এবং মানবিক সহায়তা প্রদান কাজে নিয়োজিত।

গালিসিয়ায় অবস্থা সংকটাপন্ন

গালিসিয়ার আঞ্চলিক সরকারের প্রধান আলফনসো রুয়েদা জানান, শুধু গালিসিয়াতেই ১২টি বড় দাবানল চলছে। সবগুলোই ওরেন্স শহরের নিকটে। তিনি বলেন, “এখনও অনেক বাড়ি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তাই জরুরি ভিত্তিতে লকডাউন কার্যক্রম চালানো হচ্ছে এবং বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।”

স্থানীয় প্রশাসন জনসাধারণকে সতর্ক করেছে যে, ধোঁয়া এবং ছাইতে শ্বাস নিলে শ্বাসকষ্ট, চোখে সমস্যা এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যঝুঁকি হতে পারে। তাই মুখোশ পরার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে এবং বাইরে থাকা সীমিত করার জন্য নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।

আন্তঃদেশীয় সহায়তা ও ট্রান্সপোর্ট সীমিত

রাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ ইউরোপের অন্যান্য দেশ থেকে বিমান ও বিশেষ সরঞ্জাম সহায়তা পাওয়ার অপেক্ষায় আছে। দেশজুড়ে জরুরি পরিষেবা, ফায়ার ব্রিগেড এবং স্বেচ্ছাসেবকরা রাতদিন কাজ করছেন।

জাতীয় রেল অপারেটর রেনফে রোববার (১৭ আগস্ট) ঘোষণা করেছে, মাদ্রিদ-গালিসিয়া হাই-স্পিড ট্রেন পরিষেবা স্থগিত থাকবে। এটি মূলত নিরাপত্তার কারণে নেওয়া পদক্ষেপ। এছাড়া স্থানীয় কর্তৃপক্ষ মানুষকে শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় কাজের জন্য বাইরে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে।

দাবানলের মাত্রা ও ক্ষয়ক্ষতি

দক্ষিণ ইউরোপে চলতি মৌসুমের দাবানল গত দুই দশকের সবচেয়ে ভয়াবহ। স্পেন সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে।

  • মৃত্যু সংখ্যা: ৩ জন
  • পুড়ানো এলাকা: ১,১৫০ বর্গকিলোমিটার
  • প্রতিবেশী পর্তুগালেও ব্যাপক আগুন নিয়ন্ত্রণে লড়াই চলছে

স্থানীয় সংবাদমাধ্যম এবং জরুরি সেবা সূত্রে জানা গেছে, দাবানল প্রধানত বনভূমি, কৃষিজমি এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা হাজারের বেশি। অনেক মানুষ সাময়িক আশ্রয়কেন্দ্রে স্থানান্তরিত হয়েছে।

আবহাওয়ার প্রভাব ও সতর্কতা

স্পেনের আবহাওয়া সংস্থা এএমইটি জানিয়েছে, রোববার (১৭ আগস্ট) কিছু এলাকায় তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১১৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট) পর্যন্ত পৌঁছেছে।

জরুরি সেবা বিভাগের পরিচালক ভার্জিনিয়া বারকোনেস স্প্যানিশ পাবলিক টিভিকে বলেছেন, “মঙ্গলবার (১৯ আগস্ট) থেকে তাপমাত্রা কিছুটা কমতে পারে, তবে আপাতত আবহাওয়া ‘খুবই প্রতিকূল’। বিশেষ করে ধোঁয়া ও ছাইয়ের কারণে মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দিতে পারে।”

বিজ্ঞাপন এবং স্কুল কার্যক্রমও স্থগিত রাখা হয়েছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জনগণকে পানির পরিমাণ বাড়িয়ে রাখার, বাইরে সংক্ষিপ্ত সময় কাটানোর এবং শিশু ও বৃদ্ধদের বিশেষ সতর্কতার সাথে রাখার পরামর্শ দিচ্ছে।

বিজ্ঞানীরা কি বলছেন?

বৈজ্ঞানিকরা স্পষ্টভাবে জানাচ্ছেন যে, জলবায়ু পরিবর্তন দাবানলের তীব্রতা ও ঘনত্ব বাড়াচ্ছে।

  • ইউরোপে ১৯৮০-এর দশক থেকে গড় তাপমাত্রা দ্বিগুণ হারে বাড়ছে।
  • উচ্চ তাপমাত্রা, শুষ্ক আবহাওয়া এবং বজ্রপাত দাবানলের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
  • বনাঞ্চল ও পাহাড়ি এলাকা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ।

একজন পরিবেশ বিশেষজ্ঞ বলেন, “যদি গ্রীষ্মকালীন তাপমাত্রা এইভাবে বাড়তে থাকে, ভবিষ্যতে স্পেনের মতো দেশগুলোতে দাবানল নিয়ন্ত্রণ আরও কঠিন হয়ে যাবে।”

ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের মানবিক সহায়তা

সরকারি এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের খাবার, পানি, ওষুধ এবং সাময়িক আশ্রয় দেওয়ার চেষ্টা করছে।

স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকরা জানান, অনেক পরিবার আগুনের কারণে ঘর ও ফসল হারিয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর যে বিল্ডিং এবং রাস্তা ভাঙা পর্যন্ত সংবাদে এসেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “মানুষকে শুধু নিরাপদ স্থানে সরানোই যথেষ্ট নয়, তাদের মানসিক সমর্থন এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও জরুরি।”

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

ইউরোপীয় দেশগুলো ইতিমধ্যেই স্পেনকে সাহায্যের জন্য আগুন নেভানোর বিশেষ দল এবং সরঞ্জাম পাঠাচ্ছে। আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক যেমন ইউরোপিয়ান সিভিল প্রোটেকশন মেকানিজম (EUCPM) আগুন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করছে।

পর্তুগালের সঙ্গে সমন্বিত উদ্যোগে দুটি দেশ সীমান্তবর্তী এলাকায় আগুন নেভাতে কাজ করছে। বিশেষ করে বনাঞ্চল, গ্রামাঞ্চল এবং কৃষিজমি রক্ষার জন্য পরিকল্পিত কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে।

দাবানল মোকাবিলায় সরকারের পরিকল্পনা

স্পেনের সরকার ইতিমধ্যেই নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে:

  1. সৈন্য মোতায়েন বৃদ্ধি – আরও ৫০০ সৈন্য।
  2. লোকজনকে সরিয়ে নেওয়া – বিপদমুক্ত এলাকা থেকে স্থানান্তর।
  3. পর্যায়ক্রমিক লকডাউন ও সীমিত চলাচল – ধোঁয়া ও ছাই থেকে সুরক্ষা।
  4. আন্তর্জাতিক সহায়তা গ্রহণ – ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে বিমান, সরঞ্জাম ও বিশেষ দল।
  5. মানবিক সহায়তা বৃদ্ধি – খাদ্য, পানি, চিকিৎসা ও আশ্রয়কেন্দ্র।

স্পেনে দাবানল এখনও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। তাপদাহ এবং শুষ্ক আবহাওয়া পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। সরকার, সৈন্যবাহিনী, স্বেচ্ছাসেবক এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য একত্রিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের রক্ষা ও আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ চালাচ্ছে।

বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগামি বছরগুলোতে দাবানলের সংখ্যা ও তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। তাই দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি, বনাঞ্চলের রক্ষণা এবং জনসাধারণের সচেতনতা এখন একান্ত প্রয়োজন।

MAH – 12387 ,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button